Close
বই নোট লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বই নোট লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

একুশ শতকের এজেন্ডা || আবুল আসাদ



একুশ শতকের এজেন্ডা
আবুল আসাদ

অস্তায়মান বিশ শতকের উপসংহার থেকেই গড়ে উঠবে একুশ শতকের যাত্রাপথ। তাই এই উপসংহারের স্বরূপ সন্ধান খুবই জরুরী। আমেরিকান এক লেখক তার এক শতাব্দী-সিরিজ গ্রন্থে শতাব্দীর 'Mega Trend' গুলোকে তার মত করে চিহ্নিত করেছেন। এই 'Mega Trend' গুলোর মধ্য রয়েছেঃ

১. বিশ্ব অর্থনীতি
২. বিশ্ব রাজনীতি
৩. বিশ্ব সংস্কৃতি

এই 'Mega Trend' গুলো বিশ শতাব্দীর অনন্য কারিগরি, বৈষয়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এবং এই উন্নয়নের স্রোতে বহমান জাতিসংঘের অনন্য ভূমিকার দ্বারা প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়ে আগামী শতাব্দীর সিংহদ্বারে এক বিশেষ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই রূপের নির্ণয়ই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।

প্রথমে বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের গতি-প্রকৃতির প্রশ্ন আসে। আশির দশকের শুরুপর্যন্তবিশ্ব দুই অর্থনীতি- পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের সংঘাতে সংক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তারপর মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য গ্রাসে সমাজবাদী অর্থনীতির পতন শুরুহলো। আশির দশকের সমাপ্তিতে এসে তা সমাপ্তও হয়ে গেল। আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্রাসে গোটা পৃথিবী। মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূল কথা হলোঃ শক্তিমান অর্থনীতি বিজয় লাভ করবে, পরাজিত হবে দুর্বল অর্থনীতি। এই পরাজয়ের ভয় দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করে তুলবে এবং সেও উন্নীত হবে বিজয়ীর আসনে। তাই সবাইকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্রোতে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই তত্ত্ব কথায় উলিখিত 'আইডিয়াল সিশুয়েশন' হয়তো কোনদিন আসবে কিংবা আসবেই না। তবে তার আগেই শক্তিমান অর্থনীতির করাল গ্রাসে আত্মরক্ষার অধিকারহীন দুর্বল অর্থনীতি পরাধীন হয়ে মরার মত বেঁচে থাকার পর্যায়ে চলে যাবে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ মুক্ত বাজার অর্থনীতি গলাধঃকরণ করে ইতোমধ্যেই বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় বাজার না পাবার আশংকায় বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আসবেনা বরং তা যাবে বাজার দখলকারী দেশের পুজিপতিদের কাছে। যাওয়া শুরুহয়েছে। যে বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তা গিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর অন্যথা না ঘটলে অব্যাহত এই প্রবনতা বাংলাদেশকে শিল্প পণ্যের ক্রেতা এবং কৃষিপণ্যের বিক্রেতায় রূপান্তরিত করবে।

বলা হচ্ছে, এই বিনাশ হতে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে 'ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন' (W.T.O)। কিন্তু জাতিসংঘের মত এই সংস্থাও শক্তিমানদের দ্বারা পরিচালিত এবং শক্তিমান অর্থনীতিরই স্বার্থ পুরা করবে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থা মুক্তবাজার বাণিজ্যের বিশ্বনিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ দুর্বল অর্থনীতির বেয়াড়াপনাকে শায়েস্তা করার জন্য বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে পারবে হয়তো 'মহান' মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল্যবান স্বার্থেই।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বিশ্বরূপ বিশ্বে একক অর্থনীতি গড়ার লক্ষেই। যার নিয়ন্ত্রনে থাকবে আজকের শক্তিমান অর্থনীতিগুলো, আর শোষিত হবে অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির দেশসমূহ। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের এটাই প্রবণতা।
এই প্রবণতা তার লক্ষে পৌঁছতে পারলে, একক এক বিশ্ব অর্থনীতি গড়া এবং তাকে এককেন্দ্রীক নিয়ন্ত্রনে আনার প্রয়াস সফল হলে বিশ্বের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার অশুভ প্রভাব নেমে আসবে।


অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী মুসলিম অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় 'Mega Trend' হিসেবে আসে বিশ্ব রাজনীতির কথা।

ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার নেতৃত্ব দেবে ইহুদিরা এবং যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ আমি জানি না, তবে এক বিশ্ব অর্থনীতির মতই এক বিশ্ব রাষ্ট্র গড়ার ধীর ও ছদ্মবেশী প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিসংঘ এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয় করেছে যেমন কম্যুনিষ্ট সাম্রাজ্য, তেমনি জয় করবে গোটা বিশ্ব। বিশেষ সংজ্ঞায়িত এ গণতন্ত্রের আদর্শের কাছে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অধিকারকে বলি দিতে বলা হচ্ছে। বলি না দিলে শক্তি প্রয়াগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই হাইতিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী নামানো হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। এমন হাইতি ভবিষ্যতে আরও অনেক হতে পারে।

গণতন্ত্র কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হলো গণতন্ত্রের অর্থ ও রক্তস্রোতের উপর তাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রসংহতি গড়ে তুলেছে, সে রক্তস্রোত প্রবাহিত না হলে এবং সে সময় গণতন্ত্রের নীতি অনুসৃত হলে তাদের এই রাষ্ট্রসংহতি গড়ে উঠতো না। এমনকি রেড ইন্ডিয়ানদেরও একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো। এই ইতিহাস তারা ভুলে গেছে। যেমন আমাদের প্রতি এখন তাদের নসীহত, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর গায়ে আমাদের হাত দেয়া যাবে না। তথাকথিত আদিবাসি বলে তাদের মাটিতে আমাদের পা দেয়া যাবেনা। দেশের ভিতর কোন গ্রুপবা কোন ব্যক্তি যদি বিদেশী টাকার পুতুল সেজে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চায়, তাহলেও গণতন্ত্রের আদর্শের স্বার্থে তাদের জামাই আদর দিয়ে যেতে হবে।

গণতন্ত্রের দায়িত্বহীন এই আদর্শ অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী এবং সমস্যা পীড়িত দেশ ও জাতিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এমনকি খন্ড- বিখন্ড করতে পারে। অন্তত আর কিছু না হোক বহু মত ও পথে বিভক্ত এবং দুর্বলতো করবেই। এ ধরনের দেশ ও জাতিকে তাদের স্বকীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনায়াসেই সরিয়ে আনা যায় এবং তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর বিদেশী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে এনজিও প্রভাব। এরা নামে 'নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন' হলেও এদের সরকারি ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এখনি এরা সরকারি বাজেটের একটা অংশ পাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এরা সরকারের গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টর পরিচালনার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। তখন আইন শৃংখলা ও দেশ রক্ষা ছাড়া সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না। জাতিসংঘের অনুসৃত নীতি রাষ্ট্রসমূহের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত অথবা বিলোপ করে দিতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার কাজ অনেক আগেই শুরুকরেছে এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজেও হাত দিয়েছে। অতএব জাতিসংঘ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে সংগত কারণেই রাষ্ট্রসমূহকে দেশ রক্ষা বাহিনী খাতে খরচ বন্ধ করতে বলতে পারে। সুতরাং সরকারের কাজ তখন হয়ে দাঁড়াবে শুধু শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা এবং সরকারের এই কাজও নিয়ন্ত্রিত হবে এনজিওদের দ্বারা। কারণ এনজিওরা গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টরের মালিক হওয়ার ফলে দেশের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। আর এনজিওরা, সবাই জানেন, আর্থিক ও আদর্শগত দিক থেকে মূলত জাতিসংঘ অথবা জাতিসংঘের পরিচালক শক্তিসমুহের আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় রাষ্ট্রসমুহ কার্যতই জাতিসংঘ নামের এককেন্দ্রীক এক শক্তির অধীনে চলে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হলো জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধ বিলোপ অথবা দুর্বল করারও একটা প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে। জাতিসংঘ তার উন্নয়ন, সেবা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠামুলক এজেন্সী সমুহের মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন গড়ে তুলছে এবং পারস্পরিক নির্ভরতার এক অপরিহার্য অবস্থা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা জাতীয় চিন্তাকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিবে এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনাকে বড় করে তুলবে। জাতিসংঘের পিছনে 'নাটের গুরু' যারা, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই 'শূন্য জাতীয়বোধ' অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।


এভাবেই পৃথিবীর আজকের শক্তিমানরা জাতিসংঘের ছায়ায় দাড়িয়ে জাতিসংঘকে নতুন এক বিশ্বরূপ দিতে চাচ্ছে। জাতিসংঘের জননন্দিত সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যামার শোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘকে হতে হবে 'বিশ্ব সংস্থা', 'বিশ্ব সরকার' নয়। সে হবে উন্নয়ন ও শান্তির সহায়তাকারী। কোনক্রমেই জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন সিস্টেমের ডিক্টেশনকারী নয়। কিন্তু জাতিসংঘকে আজ রাষ্ট্রসমূহকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বের দুর্বল জাতি সমুহের মত মুসলমানদেরকেও একবিংশ শতকের এই জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

বিশ্বে এক অর্থনীতি ও এক রাজনীতির মত গোটা বিশ্বকে এক সংস্কৃতির অধীনে আনারও দুর্দান্ত প্রয়াস চলছে। এই লক্ষে দুনিয়ার মানুষের জন্য একক এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কাজ করছে। তারা চাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জন্য মূল্যবোধের একক একটি মানদন্ডনির্ধারণ করতে। এই মানদন্ডের নাম দেয়া হচ্ছে 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম'। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে যে, মানবাধিকার সকলের উর্ধ্বে। জাতীয় ধর্ম, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি অধিকার সবই এর অধীন। এই অধিকারগুলো ততটুকুই ভোগ করা যাবে, যতটুকু 'মানবাধিকার' অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের এক দলিলে এভাবে বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জীবন ও পরিচয়ের বিকাশসহ সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই স্বীকৃত। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকারকে সীমাহীন করা যাবে না। যখনই তা মানুষের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপকরে তখনই সাংস্কৃতিক অধিকার অচল হয়ে পড়ে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক অধিকার মানুষের মৌল স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। (United Nation Background Note-by Diana Ayten Shenker) এই দৃষ্টিভঙ্গিই জাতিসংঘের নাইরোবী সম্মেলন, কায়রোর জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন, কোপেন হেগেনের সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন, বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আরও হবে। উদ্বেগের বিষয় এসব সম্মেলনে সুকৌশলে প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (Secular Humanism) প্রতিষ্ঠার দলিলে অধিকাংশ মুসলিম দেশও দস্তখত করেছে। অথচ জাতিসংঘ প্রচারিত 'ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ' এর তত্ত্ব মেনে নিলে ইসলামকে কেটে ছোট বিকলাঙ্গ করে মসজিদে পুরে রাখতে হবে। তাদের বলা উচিত ছিল, তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকার আইন নিশ্চিত ভাবেই মানব জীবন, তার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষনকে বিপর্যন্ত ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। ইসলামের আদর্শ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে কার্যকরভাবে যদি মানব মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই হয় সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই কথা কেউ আমরা বলিনি।

এভাবে অন্য কেউও বলছে না, অন্য জাতি, অন্য ধর্মও নয়। তার ফলে, 'ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ'-ই বিশ্ব সংস্কৃতির একমাত্র মানদন্ডহয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্য কথায় এটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতি।

এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করতে পারবো না। উত্তরাধিকার আইনকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী, শান্তিরআইন অভিহিত হবে বর্বর বলে, পর্দাকে বলা হবে মানবাধিকারের খেলাপ, কুরবানিকে বলা হবে অপচয় ইত্যাদি। এমনকি ইসলামের দাওয়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোথাও জাতীয় আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠিত হলে তাকে অভিহিত করা হবে মানবাধিকার বিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে। 'সেকুলার হিউম্যানিজম' প্রকৃত পক্ষে সূদুরপ্রসারী একটা ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য মানুষকে তার অলক্ষ্যে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে নেয়া। মানুষের ধর্ম না থাকলে তার জাতীয়তা ধ্বসে পড়বে। জাতীয়তা ধ্বসে পড়লে তার রাষ্ট্রও ধ্বসে পড়বে। এটাই চাচ্ছে আজকের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বনিয়ন্ত্রকরা।

বিশ্বে ধর্মসমুহকে বিশেষ করে ইসলামকে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিরোধী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে একবিংশ শতকে।

বিশেষ করে ইসলামকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, অন্য ধর্মগুলোর কোনটিই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী নয়। সুতরাং তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে না, করতে চাইলেও তারা পারবে না। কিন্তু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। শুধু ইসলামই তাদের চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে পারে। ইসলামের শত্রুরাও এ কথা বলছে। The End History- এর লেখক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা কম্যুনিজমের ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার বিজয় প্রমান করছে যে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মতবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে'। কিন্তু তিনি আবার বলেছেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা একটা হবে ধর্মের সাথে আসছে একবিংশ শতাব্দীতে এবং তাঁর মতে সে ধর্ম 'ইসলাম'।

সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে, মানবতার সামনে, তার মোকাবিলা ইসলামকেই করতে হবে।

আর এ দায়িত্ব বিশ্বের মুসলমানদের। আনন্দের বিষয়, এ দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় জীবনে যে রেনেসাঁর প্রয়োজন সে রেনেসাঁ আজ সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম বিশ্বে। রেনেসাঁর নিশানবর্দার সংগঠনেরও সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম দেশে দেশে। ক্রমবর্ধমান হারে তরুনদের সম্পৃক্ততায় এ সংগঠনগুলো বিকশিত হয়ে উঠছে। ত্যাগ ও কোরবানীর ক্ষেত্রেও রেনেসাঁ-কাফেলার নিশান বর্দাররা পিছিয়ে নেই। আজ গোটা দুনিয়ায় আদর্শের জন্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিচ্ছে একমাত্র মুসলমানরাই।

তবে প্রয়োজনের তুলনায় এবং চ্যালেঞ্জের নিরিখে এটুকু যথেষ্ট নয়। এসব কাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মৌল কিছু বিষয়ে মুসলিম তরুনদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌল এই বিষয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়.

১. নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও তার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন, কোরআন-হাদীস এবং মহানবীর জীবন সম্পর্কেতো অবশ্যই, ইসলামের আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হবে।

২. ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রতিটি মুসলিম তরুনকে তার চারপাশে যা আছে, যা ঘটছে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নিরীক্ষনী দৃষ্টি রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব বিষয়ই এ নিরীক্ষনের ক্ষেত্রে তাদের মনে রাখতে হবে, দৃষ্টি-মনোহারীতা নয় সত্যই আসল কথা। আজ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন প্রচারণা জোরে খুব সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় গ্রহন বা বর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিবোধ সামনে রেখে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহন করতে হবে।

৩. তীব্র সাংস্কৃতিক সংঘাতের এই যুগে মুসলিম তরুনদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক নীতিবোধ ও পরিচয়কে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর্ট-আর্কিটেকচার থেকে শুরুকরে জীবন চর্চার সকল ক্ষেত্রে ইসলামের চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে ইসলামের সাথে অন্য সংস্কৃতিগুলোর মৌল পার্থক্য সমূহ। এই পর্যালোচনার জ্ঞান তাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমর্থ্য করে তুলবে।

৪. মুসলমানদের বিজ্ঞানের যে পতাকা ৯শ বছর আগে অবনমিত হয়েছিলো এবং সাড়ে ৬শ বছর আগে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেই ৪ পতাকার গর্বিত শির আবার উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য মুসলিম তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।

৫. ইসলাম সকল যুগের সর্বাধুনিক মতবাদ। এ মতবাদকে যুগপূর্ব অচল ভাষা বা কৌশল নয়, যুগশ্রেষ্ঠ ভাষায় যুগোত্তর লক্ষ্য সামনে রেখে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু তাহলেই এই আদর্শ যুগ-চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সকল মানুষের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে।

এই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে মুসলিম তরুনরা যে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে সজ্জিত হবে তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মূলতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এই চ্যালেঞ্জর মধ্যে অবশ্যই অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরশক্তির মত দিকগুলো আছে। তবে এগুলোর অর্জন, অধিকার, ব্যবহার, কার্যকারিতা- সবকিছুই বুদ্ধির শক্তির উপর নির্ভরশীল। কম্যুনিজম রক্ষার সব অস্ত্র সব অর্থ সোভিয়েত ভান্ডারে থাকার পরও বৈরী জ্ঞান ও সংস্কৃতির সয়লাবে যেমন তা শেষ হয়ে গেছে, তেমনি, 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম' এবং আগ্রাসী পুঁজি ও আধিপত্য রক্ষার 'গণতন্ত্র' তার ভান্ডারে সব অস্ত্র, সব অর্থ রেখেই শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রয়োজন শুধু ইসলামের মহান মানবতাবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধুনিকতম মানের প্রচন্ড এক সয়লাব।

লেখক-
আবুল আসাদ
সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম 
বই- একুশ শতকের এজেন্ডা

বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ || লেখক- শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ || লেখক- মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী

 বইনোট: ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ
লেখক- শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
(১৯৮৫ সালে রাজশাহী মহানগরীর দায়িত্বশীল পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ে শব্বেদারীতে প্রদত্ত বক্তব্য পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। তৎকালীন রাজশাহী মহানগরী আমীর ছিলেন অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।)

লেখক পরিচিতি:
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী(রহ.)।
১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা লুৎফুর রহমান। মাতা মোমেনা খাতুন। তিনি ১৯৭০-৭১ দুই সেশন নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। ১৯৮৮-২০০০ সাল পর্যন্ত সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ থেকে ২০১০ সালে গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্ব-পদে বহাল ছিলেন। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে পাবনা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের হয়ে পাবনা-১ আসন থেকে ২য় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ২২মে পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালের ২৫ মে থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা নিজামীর ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। তিনি ২০১০ সালের জুন মাসে গ্রেফতার হন এবং ২০১৬ সালের ১১ মে রাত ১২টা ১০ মিনিটে আওয়ামী ট্রাইবুনালের ভিত্তিহীন অভিযোগে ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে শাহাদাত বরণ করেন।

ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ

ইনফাকের অর্থ:
ইনফাকের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ: ইনফাক শব্দটির মূল ধাতু (نفق) যার অর্থ সুড়ঙ্গ। যার একদিক দিয়ে প্রবেশ করে আর একদিন দিয়ে বের হওয়া যায়।
মুনাফিক এবং নিফাক শব্দদ্বয়ও এই একই ধাতু থেকে গঠিত। অর্থের দিক দিয়ে মোটামুটি একটা সামঞ্জস্য আছে। নাফাকুন থেকে ইনফাক গঠিত হয়েছে। 
শাব্দিক অর্থের আলোচনায় আমরা ইনফাকের দুটো দিক পেয়ে থাকি। 
এক. এ পরিমাণ খরচ করতে হবে যাতে অর্থ-সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ না আসে। বা দাতার মনে সঞ্চয়ের ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার সুযোগ না আসে।
দুই. ভরণ-পোষণ বা খোরপোষের অর্থের তাৎপর্য হল দাতা যার জন্যে দান বা খরচ করবে তার প্রয়োজন পূরণ করার মত অর্থ অবশ্যই ব্যয় করবে।

ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ:

ইনফাকের অর্থ এবং ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ একত্রে মিলালে ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ দাঁড়ায়: জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রয়োজন পূরণ, এর উপায়-উপকরণ যোগাড় ও এই মহান কাজটি পরিচালনার জন্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্যে অর্থসম্পদ খরচ করা। চাঁদার মনোভাব নিয়ে অর্থ দান করার মাধ্যমে এর হক আদায় হতে পারে না। তাই ইসলামী আন্দোলনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যাপারে চাঁদার পরিভাষা ব্যবহার না করে 'এয়ানাত'-এই আরবী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ সহযোগিতা দান।

ইনফাকের তাৎপর্য:
আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার খাতে আমাদেরকে মাল সম্পদ খরচ করতে হবে কেন?
আল্লাহর তাআলা তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর পথে জিহাদের যে আহবান দিয়েছেন তার মধ্যেই উপরিউক্ত প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে। আল্লাহ তাআলার ঘোষণাঃ "তোমরা জিহাদ কর আল্লাহর পথে মাল দিয়ে এবং জান দিয়ে।" অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই জিহাদে বা সংগ্রামে মালের কোরবানী এবং জানের কোরবানীর প্রয়োজন আছে। এই দুটো জিনিসের কোরবানী দেয়ার মত একদল মর্দে মুমিন, মর্দে মুজাহিদ তৈরি হলেই আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রাম বিজয় হবে যেমন বিজয়ী হয়েছিল রাসূলে পাক (সা.)-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরামের (রা.) মালের কোরবানী ও জানের কোরবানীর বিনিময়ে। আল্লাহর দ্বীন কায়েমের এই মহান সংগ্রাম দাবী করে যে এ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের কাছে তাদের নিজের জান ও মালের তুলনায় তথা ইহ জাগতিক যাবতীয় স্বার্থ ও লোভ-লালসার তুলনায় আল্লাহর রহমত ও সন্তোষই হতে হবে অধিকতর প্রিয়।


ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর ভূমিকা:

আমরা জানি, নবুওয়াতের ঘোষণা আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা.) আরবের একজন অন্যতম ধনী ব্যক্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী খাদিজাতুল কুবরার (রা.) ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তিনি এ অবস্থায় উন্নীত হন। তাছাড়া হযরত খাদিজার সম্পদ ব্যবহারের তাঁর সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, নবুওয়াতের ঘোষণা আসার পর থেকে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তাঁর সম্পদ আর বিন্দু পরিমাণও বৃদ্ধি পায়নি। বরং তিলে তিলে সব আল্লাহর পথে নিঃশেষ হয়েছে।

ইনফাকের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামগণের ভূমিকা:

আল্লাহর শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামগণের (রা.) ভূমিকা দুনিয়ার ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা আল্লাহর রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়ে মালের ও জানের কোরবানী পেশের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁদের এই ভূমিকার জন্যে স্বয়ং আল্লাহ্ সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, "তাদের প্রতি আল্লাহ্ খুশি হয়েছেন আর তাঁরাও আল্লাহর প্রতি খুশি হয়েছে।"

  • হযরত খাদিজাতুল কুবরার (রা.)
  • হযরত আবু বকর (রা.)
  • হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)
  • হযরত উসমান (রা.)
  • আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)
  • মুহাজির ও আনসারগণ।

যে সকল সাহাবায়ে কেরাম রা: ভূমিকা রেখেছেন:

বর্তমান যুগে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিপক্ষ ও তাদের প্রস্তুতি:

ইসলামী আন্দোলনের যথার্থ প্রস্তুতি নিতে হলে বর্তমান যুগ-সন্ধিক্ষণে এ আন্দোলনের প্রতিপক্ষ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের প্রস্তুতিরও যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বর্তমান বিশ্বে যে দেশেই পরিচালিত হোকনা কেন তার প্রধান প্রতিপক্ষ দুই পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়া। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিপক্ষ হল তাদের প্রভাব বলয়াধীন রাষ্ট্রশক্তি ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। বাংলাদেশের জন্যে ঐ দুই প্রধান প্রতিপক্ষের সাথে আর একটি বাড়তি প্রতিপক্ষ হিসাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে আমাদের নিকট প্রতিবেশী একটি পাতি বৃহৎ শক্তি। এই প্রতিপক্ষ সার্বিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামের পুনর্জাগরণ ঠেকানোর জন্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাদের পারস্পরিক স্বার্থের, দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকলেও ইসলামের ইস্যুতে প্রায় সর্বত্র তারা এক ও অভিন্ন ভূমিকা পালন করে আসছে। গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজির কারণে কোথাও কোথাও কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পরিলক্ষিত হলেও সেটা বাহ্যিক ব্যাপার মাত্র। মূলে ইসলামী পুনর্জাগরণ ও আন্দোলনকে ঠেকানোর ব্যাপারে তাদের কোন শৈথিল্য নেই। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে তাঁরা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমসমূহ ইহুদীদের সহায়তায় ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে।

মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে চিন্তার বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যে রীতিমত Intelectual and cultural Agression চালাচ্ছে। (বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন) বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত করছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে প্রশাসনকে পর্যন্ত ব্যবহার করছে। এনজিওদের জাল বিস্তার করে সামাজিকভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার পাশাপাশি আমাদের স্বকীয় মূল্যবোধ ধ্বংসের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। সেই জালে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বস্তুগত সহযোগিতা দিয়ে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের উপর সরাসরি আঘাত হানার ব্যবস্থা করছে।

ইসলামের অর্থ ব্যয়ের বিভিন্ন দিক:

ইসলাম ও ঈমানের মূল দাবীই যেহেতু আল্লাহর কাছে জান ও মাল সোপর্দ করার। ইসলামের বাস্তব কাজ যেহেতু আল্লাহর এবাদত এবং বান্দাদের সেবা করা, সেহেতু মুসলিম সমাজের বিভিন্ন দিকে ও বিভাগে অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা ঐতিহ্যগতভাবেই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। 'নদী মরে গেলেও রেখা থাকে' এই প্রবাদ বাক্যের মতই মুসলিম সমাজ তার নিজস্ব মূল্যবোধ প্রায় হারিয়ে ফেললেও তাদের অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা বা ঐতিহ্য একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

ইসলাম অর্থ-সম্পদের কোরবানীর দু'ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে। একটা বাধ্যতামূলক যেমন- যাকাত। অপরটি স্বেচ্ছামূলক। যেমন- গরীব, নিকট আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে দুঃস্থ অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা। কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন- মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতি কায়েমের কাজে অর্থ ব্যয় করা। স্বেচ্ছায় নিঃস্বার্থভাবে অর্থ ব্যয়ের মন-মানসিকতা তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্য বাধ্যতামূলক দান যাকাতের একটা ভূমিকা আছে। বরং সত্যি বলতে কি, প্রতিদানের আশা ছাড়া, কোন বৈষয়িক স্বার্থ ছাড়া মানুষ অর্থ ব্যয়ে অভ্যস্ত হোক এটা যাকাতের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য।

যাই হোক, বাধ্যতামূলক দান অর্থাৎ যাকাতের যে আটটি খাত আছে তার মধ্যেও ফি সাবিলিল্লাহর একটা খাত আল্লাহ্ রেখেছেন। মানুষ স্বেচ্ছামূলকভাবে যে বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করে থাকে, তার-মধ্যেও ফি সাবিলিল্লাহর খাতে বা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ আছে। শুধু সুযোগ আছে তাই নয় বরং আল্লাহর কোরআন এবং রাসূলের হাদীসের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, আল্লাহর পথে জিহাদ হলো সর্বোত্তম আমল। অতএব এই সর্বোত্তম আমলের জন্যে অর্থ ব্যয় হবে সর্বোত্তম খাতে অর্থ ব্যয়- এটাই স্বাভাবিক।

যেই দেশে আল্লাহর দ্বীন কায়েম নেই সেখানে যাকাতের আটটি খাতের মধ্য থেকেও ফি সাবিলিল্লাহর খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হলে যাকাতের উদ্দেশ্যেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে দানের সকল দিক ও বিভাগের তুলনায় আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে দান করাই সর্বোত্তম দান। যে কোন দানের তুলনায় এ কাজের দানে সওয়াব হবে সবচেয়ে বেশি। ইসলামের এই শিক্ষাটা আমরা ভুলতে বসেছি বলেই আজ ইসলামী আন্দোলনের কাজে পয়সা দেওয়াকে অনেকে রাজনৈতিক দলে চাঁদা দেয়ার শামিল মনে করে। সর্বোত্তম সওয়াবের কাজতো দূরের কথা, আদৌ সওয়াব হয় কিনা এ সম্পর্কেই সন্দেহ-সংশয় পোষণ করেন। 

ইনফাকের ক্ষেত্রে ইসলামী আন্দোলনের ঐতিহ্য:

ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্নমুখী ঐতিহ্য সৃষ্টিতে প্রধানতঃ অবদান রেখেছেন আম্বিয়ায়ে কেরামগণ (আ.)। এরপর আল্লাহর সেইসব বান্দাদের ভূমিকা স্মরণযোগ্য যাদেরকে আল কোরআনে সিদ্দিকীন, সালেহীন এবং শোহাদা নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁদের ভূমিকা আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হওয়া সত্ত্বেও মনের কোণে প্রশ্ন জাগতে পারে। নবীদের ব্যাপার তো আলাদা, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর ব্যাপার তো আরো ব্যতিক্রম। নবীদের সাথী-সঙ্গীদের ব্যাপারও আলাদা। কাজেই দূর অতীতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি নিকট অতীতের বা আজকের সমসাময়িক বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস-ঐতিহ্যই এ ক্ষেত্রে বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।

নিকট অতীতে আমাদের উপমহাদেশে হযরত সৈয়দ আহাম্মদ শহীদ ব্রেলভী পরিচালিত মুজাহিদ আন্দোলনের কথা আমাদের মোটামুটি জানা থাকার কথা। এই আন্দোলনে বাংলার তৌহিদী জনতা যেমন পায়ে হেঁটে যোগদানের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, তেমনি অকাতরে এই আন্দোলনের জন্যে আর্থিক সহযোগিতাও করেছেন। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে মুজাহিদ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের বসবাস ছিল সেইসব অঞ্চলের লোকদের মধ্যে এখনও ওশর দান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দ্বীনি খেদমতে স্বতস্ফূর্তভাবে দানের রীতি চালু দেখা যায়। আজকের বিশ্বের দু'টি আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পন্ন ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও জামায়াতে ইখওয়ানুল মুসলেমিনের প্রতিষ্ঠাতা ও এর সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সাহাবায়ে কেরামগণের জানের কোরবানী ও মালের কোরবানীর ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন। সাহাবায়ে কেরামগণ ঈমানের ঘোষণা দিয়ে যেভাবে জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, ইসলামী আন্দোলনে শরীক লোকেরা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুরূপ জুলুম ও নির্যাতনেরই সম্মুখীন হচ্ছেন। তাঁরা যেভাবে অর্থ-সম্পদ এ পথে ব্যয় করতেন আজকের যুগের ইসলামী আন্দোলনের লোকেরাও অনুরূপ ত্যাগ, কোরবানীর প্রয়াস পাওয়ার চেষ্টা করছে। 
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র.) তাঁর অসংখ্য বই-পুস্তকের আয় থেকে কোটিপতি হতে পারতেন কিন্তু তাঁর মধ্য থেকে মাত্র ২/৩টি বইয়ের আয় পরিবারের জন্যে রেখে বাদবাকী সমস্ত বইয়ের (যার অসংখ্য সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। অসংখ্য ভাষায় যার অনুবাদ ও প্রকাশ হয়েছে) ইসলামী আন্দোলনকে ওয়াকফ করেছেন। তাঁর সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তাঁরা অনেকেই জীবনের ক্যারিয়ার এই আন্দোলনের জন্যে কোরবানী দিয়েছেন। 

নোট সংকলনে- আরমানের খেরোখাতা 

শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

বইনোট: ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী || সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী রাহি.

ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী

লেখক: সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী রাহি.
অনুবাদক: মাওলানা আব্দুল মান্নান তালিব

প্রকাশকের কথা :
কোন উদ্দেশ্য, কোন আন্দোলন, কোন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ সফল হতে হলে সে আন্দোলনের সৈনিকদের বিশেষ কতগুলো গুণ থাকা দরকার। যথা: 
১. সুন্দর, বলিষ্ঠ, উন্নত আর উজ্জল চরিত্রের অধিকারী হওয়া।
২. আন্দোলন ও ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ।
৩. আখেরাতে আল্লাহরসন্তুষ্টি লাভ।

★★মূল বইটি দু'ভাগে বিভক্ত-
০১. ভূমিকা ও 
০২. মূল বক্তব্য।

★বইয়ের ভূমিকাকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

০১. হতাশার দিক :
১) আগ্রহ, উদ্যোগ ও যোগ্যতার অভাব
২) প্রভাবশালী অংশ সমাজ ভাঙ্গনে লিপ্ত
৩) সমাজ ভাঙ্গনে বৃহত্তম শক্তি সরকার।

০২. আশার দিক :
১) সমাজে কিছু সৎ ও যোগ্যলোক রয়েছে
২) সামষ্টিক ভাবে লোকজন অসৎ প্রবণ নয়
৩) ইসলাম বিরোধী শক্তির দুটি জিনিসের অভাব-
ক) চারিত্রিক শক্তি
খ) ঐক্যের শক্তি।

০৩. করণীয় কাজ সমূহ :
১) আবেগ বর্জিত ধীর ও সুস্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে
২) হঠাৎ ফল পাওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে
৩) সুশিক্ষীত কর্মী বাহিনী গঠন করতে হবে
৪) ব্যক্তি গঠন করতে হবে।

★★ মূল বক্তব্য কে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে :

০১. ব্যক্তিগত গুণাবলি সমূহ :

১) ইসলামের যথার্থ জ্ঞান
২) ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাস
৩) চরিত্র ও কর্ম
৪) দ্বীন হচ্ছে জীবন উদ্দেশ্য।

০২. দলীয় গুণাবলি সমূহ : 

১) ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা
২) পারস্পরিক পরামর্শ
৩) সংগঠন ও শৃঙ্খলা
৪) সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনা।

০৩. পূর্ণতা দানকারীর গুণাবলি সমূহ :
১) আল্লাহ সাথে সম্পর্ক ও আন্তরিকতা
২) আখেরাতের চিন্তা
৩) চরিত্র মাধুর্য

০৪. মৌলিক ও অসৎ গুণাবলি সমূহ :
১) গর্ব ও অহংকার
২) প্রদর্শনেচ্ছা
৩) ত্রুটিপূর্ণ নিয়ত।

০৫. মানবিক দুর্বলতা সমূহ :
১) আত্মপূজা
২) আত্মপ্রীতি
৩) হিংসা ও বিদ্বেষ
৪) কুধারণা
৫) গীবত
৬) চোগলখোরী
৭) কানাকানি ও ফিসফিসানী
৮) মেজাজের ভারসাম্যহীনতা
৯) একগুঁয়েমী
১০) একদেশদর্শীতা
১১) সামষ্টিক ভারসাম্যহীনতা
১২) সংকীর্ণমনতা
১৩) দুর্বল সংকল্প।

★ গর্ব অহংকার থেকে বাঁচার উপায় সমূহ :
১) বন্দেগীর অনুভূতি
২) আত্মবিচার
৩) মহৎ ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি
৪) দলগত প্রচেষ্টা।

★★কয়েকটি বিষয়ে বইয়ের আলোকে ব্যাখ্যা :

★ চরিত্র মাধুর্যের মূল বিষয়বস্তু :
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের হতে হবে উদার হৃদয় ও বিপুল হিম্মতের অধিকারী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবতা দরদী। তাদের হতে হবে ভদ্র ও কোমল স্বভাব সম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল ও কষ্ট সহিষ্ণু। তাদের দ্বারা অন্যদের উপকার বিনে ক্ষতি হবে এমন ধারণাও কেউ করতে পারবে না। তারা নিজের প্রাণের চাইতে কমের উপর সন্তুষ্ট থাকবে ও অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশী দিবে। তারা নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করবে ও অন্যের গুণাবলীর কদর করবে।
তারা অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেবার মতো বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে, অন্যের দোষত্রুটি মাফ করে দেবে এবং নিজের জন্যে কারোর উপর প্রতিশোধ নেবে না। তারা অন্যের সেবা গ্রহন করে নয় বরং অন্যকে সেবা করে আনন্দিত হবে। তারা কোন প্রকার প্রসংশার অপেক্ষা না করে এবং কোন প্রকার নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে। আল্লাহ ছাড়া কারো পুরষ্কারের প্রতি দৃষ্টি দেবে না। ধন-সম্পদের বিনিময়ে তাদেরকে ক্রয় করা যাবে না কিন্তু সত্য ন্যায়ের সামনে তারা নির্দ্বিধায় ঝুকে পড়বে। তাদের শত্রুরাও তাদের উপর বিশ্বাস রাখবে যে, কোন অবস্থাই তারা ভদ্রতা ও ন্যায়নীতি বিরোধী কোন কাজ করবে না। এ চারিত্রিক গুণাবলী মানুষের মন জয় করে নেয়। এগুলো তলোয়ারের চাইতেও ধারালো এবং হীরা মনি মুক্তার চাইতেও মূল্যবান। যে এহেন চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনকারী সে তার চারপাশের জনবসতির উপর বিজয় লাভ করে।

★ "দ্বীন হচ্ছে জীবন উদ্দেশ্য" এর ব্যাখ্যা :
সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনে ব্রতী কর্মীদের মধ্যে খোদার বাণী বুলন্দ করা এবং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিছক তাদের জীবনের একটি আকাঙ্খার পর্যায় ভুক্ত হবে না বরং এটিকে তাদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। এক ধরনের লোক দ্বীন সম্পর্কে অবগত হয়, তার উপর ঈমান রাখে, এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম তাদের জীবনের লক্ষ্য বিবেচিত হয় না বরং সততা ও সৎকর্ম করে এবং এই সংগে নিজেদের দুনিয়ার কাজ কারবারে লিপ্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এরা সৎ লোক। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কার্যত প্রতিষ্ঠিত থাকলে এরা তার ভালো নাগরিক হতে পারে। কিন্তু যেখানে জাহেলী জীবনব্যবস্থা চতুর্দিক আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তাকে সরিয়ে তদস্থলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্ন দেখা দেয় সেখানে নিছক এ ধরনের সৎ লোকদের উপস্থিতি কোন কাজে আসে না বরং সেখানে এমন সব লোক প্রয়োজন হয় যাদের জীবনোদ্দেশ্য রুপে এ কাজ বিবেচিত হয়। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ তারা অবশ্যই করবে কিন্তু তাদের জীবন একমাত্র এ উদ্দেশ্যের চারদিকে আবর্তন করবে। এ উদ্দেশ্য সম্পাদন করার জন্য তারা হবে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ জন্য নিজেদের সময় সামর্থ ধন-মাল ও দেহ-প্রাণের সকল শক্তি এবং মন- মস্তিষ্কের সকল যোগ্যতা ব্যয় করতে তারা প্রস্তুত হবে। এমনকি যদি জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তাতেও তারা পিছপা হবে না। এ ধরনের লোকেরাই জাহেলিয়াতের আগাছা কেটে ইসলামের পথ পরিষ্কার করতে পারে। দ্বীনের সঠিক নির্মূল জ্ঞান, তার প্রতি অটল বিশ্বাস, সেই অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং তার প্রতিষ্ঠাকে জীবনোদ্দেশ্য পরিণত করা এগুলো এমনসব মৌলিক গুণ যেগুলো ব্যক্তিগত ভাবে অপরিসীম। অর্থাৎ এ গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ছাড়া এ কাজ সম্পাদনের কল্পনাই করা যেতে পারে না। বলাবাহুল্য, এহেন ব্যক্তিরা যদি সত্যিই কিছু করতে চায় তাহলে তাদের একটি দলভুক্ত হয়ে এ কাজ করা অপরিহার্য। তারা যে কোন দলভুক্ত হোক এবং যে কোন নামে কাজ করুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি জানে, নিছক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সমাজ ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনা যেত পারে না। এজন্য বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা নয়, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

★ দূর্বল সংকল্প :
দুর্বল সংকল্পের কারণে মানুষ প্রথম দিকে কাজে ফাঁকি দিতে তাকে। দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইতস্তত করে। উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হয়। যে কাজকে সে নিজের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গন্য করে এগিয়ে এসেছিল দুনিয়ার প্রত্যেকটি কাজকে তার উপর অগ্রাধিকার দিতে থাকে। তার সময়, শ্রম ও সম্পদের মধ্যে তার ঐ তথাকথিত জীবন উদ্দেশ্যের অংশ হ্রাস পেতে থাকে এবং যে দলকে সত্য মনে করে সংযুক্ত হয়েছিল তার সাথেও সে নিছক যান্ত্রিক ও নিয়মানুগ সম্পর্ক কায়েম রাখে। ঐ দলের ভালমন্দের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না এবং তার বিভিন্ন বিষয়ে কোন প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করে না।

★ ধৈর্য :
ক) তাড়াহুড়া না করা, নিজের প্রচেষ্টার তড়িৎ ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত না হারানো।
খ) তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতা রোগে আক্রান্ত না হওয়া
গ) বাধা বিপত্তির বিরোচিত মোকাবিলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা।
ঘ) দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়া।
ঙ) সকল প্রকার ভয় ভীতি ও লোভ লালসার মোকাবিলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খায়েসের বিপক্ষে কর্তব্য সম্পাদন করা।

★ চরিত্র ও কর্ম :
চরিত্র ও কর্ম হচ্ছে কথা অনুযায়ী কাজ। যে বস্তুকে সে সত্য মনে করে সে তার অনুসরণ করে। যাকে বাতিল বলে গণ্য করে তা থেকে দূরে সরে থাকে। যাকে নিজের দ্বীন ঘোষণা করে তাকে নিজের চরিত্র ও কর্মের দ্বীনে পরিণত করে। সকল প্রকার ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা, বিরোধীতা ও সকল প্রকার প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সত্য পথে অবিচল থাকে।

★ প্রজ্ঞা :
ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের যথার্থ জ্ঞান। (যে ব্যক্তি ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে সর্ব প্রথম যে জিনিসটি সে কায়েম করতে চায় তা জানতে ও বুঝতে হবে)। এ কাজের জন্য ইসলামের নিছক সংক্ষিপ্ত জ্ঞান যথেষ্ট নয় বরং কম বশেী বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন। এর স্বল্পতা ও বিপুলতা মানুষের যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। এজন্য এ পথের প্রত্যেকটি পথিককে এবং আন্দোলনের প্রত্যেকটি কর্মীকে মুফতি বা মুজতাহিদ হতে হবে এমন কোন কথা অবশ্য নেই তবে তাদের প্রত্যেককে অবশ্যই ইসলামী আকিদা বিশ্বাসকে জাহেলী চিন্তা-কল্পনা ও ইসলামী কর্মপদ্ধতিকে জাহেলিয়াতের নীতি-পদ্ধতি থেকে আলাদা করে জানতে হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগে ইসলাম মানুষকে কি পথ দেখিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হবে হবে। এ জ্ঞান ও অবগতি ছাড়া মানুষ নিজে সঠিক পথে চলতে পারে না, অন্যকেও পথ দেখাতে পারে না এবং সমাজ পরিগঠনের জন্য যথার্থ পথে কোন কাজ করতেও সক্ষম হয় না। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান এমন পর্যায়ে থাকতে হবে যার ফলে তারা গ্রাম ও শহরের লোকদেরকে সহজ সরল ভাবে দ্বীনের কথা বুঝাতে সক্ষম হবে। কিন্তু উন্নত বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান অধিক মাত্রায় থাকতে হবে। তাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। শিক্ষিত লোকদের সকল সন্দেহ সংশয় নিরসন করতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে। ইসলামের আলোকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষা ও শিল্পকে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে বিন্যস্ত করতে হবে। ইসলামী আকিদা ও চিন্তার ভিত্তির উপর একটি নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মত যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এই সঙ্গে যা কিছু ভাঙ্গার তাকে ভেঙ্গে ফেলে তদস্থলে উন্নততর বস্তু গড়ার এবং যা কিছু রাখার তাকে কায়েম রেখে একটি উত্তম ও উন্নততর ব্যবস্থায় তাকে ব্যবহার করার মতো গঠনমূলক যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তাকে হতে হবে।

★ চোগলখোরী :
গীবত যে আগুন জ্বালায় চোগলখোরী তাকে বিস্তৃত করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়। স্বার্থবাদিতার প্রেরণাই হয় এর মধ্যে আসল কার্যকর শক্তি। চোগলখোর ব্যক্তি কারুর কল্যাণকামী হতে পারে না। নিন্দিত দুজনের কারুর কল্যাণ তার অভিস্পীত হয় না। সে দুজনেরই বন্ধু সাজে কিন্তু অমঙ্গল চায়। তাই সে মনযোগ দিয়ে দু'জনেরই কথা শুনে, কারোর প্রতিবাদ করে না। তারপর বন্ধুর নিকট এ খবর পৌঁছে দেয়। এভাবে যে আগুন এক জায়গায় লেগেছিল তাকে অন্য জায়গায় লাগাতেও সাহায্য করে। ইসলামী শরীয়তে এ কাজকে হারাম গণ্য করা হয়েছে।

★ "আখেরাতের চিন্তা" এর ব্যাখ্যা :
যারা মুমিন তারা দুনিয়ার সমস্ত কাজ আখেরাতের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই করে। দুনিয়া মুমিনের কর্মস্থল এবং সবকিছু তাকে এখানেই করতে হয়। কিন্তু এতদসত্বেও সে দুনিয়ার জন্যে কাজ করে না বরং আখেরাতের জন্য করে এবং দুনিয়ার ফলাফলের দিকে লক্ষ্য থাকে না বরং তার লক্ষ্য থাকে আখেরাতের ফলাফলের প্রতি। আখেরাতে অকল্যাণ বয়ে আনে এমন সকল কাজ থেকে মুমিন সর্বদা দূরে থাকে। মুমিন তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আখেরাতের জবাবদিহীতার অনুভূতি নিয়ে অতিবাহিত করেন। কারণ আখেরাতের শান্তি ও পুরস্কার দুনিয়ার কাজের উপর ভিত্তি করেই দেয়া হবে। আখেরাতে আল্লাহই একমাত্র বিচারক থাকবেন। আল্লাহকে ভয় করা, তার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা আখেরাতের উপলব্ধির উপর নির্ভর করে। তাই বলা যায় আখেরাতের চিন্তা মুমিনের নেক আমল বৃদ্ধির টনিক হিসাবে কাজ করে।

সংকলনে:
আরমানের খেরোখাতা 

বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

বইনোট : চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান || লেখক : নঈম সিদ্দিকী


চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান

নঈম সিদ্দিকী


লেখক পরিচিতি:

নঈম সিদ্দিকী, প্রসিদ্ধ ইসলামী সাহিত্যিক। মাসিক তরজমানুল কুরআন এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত "চেরাগে রাহ" পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রাসূল (সা.) এর সীরাত "মুহসিনে ইনসানিয়্যাত" নামক গ্রন্থটি (অনুবাদঃ- মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সাঃ) প্রণয়ন করেন। এ বইয়ের মূল নাম ছিল 'তামীরে সীরাত কে লাওয়াযিম'।


চরিত্র: আচার, আচরণ, স্বভাব-প্রকৃতি, ব্যবহারবিধি, রীতিনীতি, কায়দাকানুন অর্থাৎ যা দ্বারা মানুষের ভালমন্দ বিচার করা যায় তাকে চরিত্র বলে।

ইসলামী সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনে কর্মীদের চরিত্রই মুখ্য হাতিয়ার।



বইটি চার ভাগে বিভক্ত :


১. ভূমিকা


২. আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক


৩. সংগঠনের সাথে যথাযথ সম্পর্ক


৪. সহযোগীদের সাথে যথাযথ সম্পর্ক।



ভূমিকাঃ-

মানুষের তৎপরতা যত বৃদ্ধি পায়, শয়তানের হস্তক্ষেপও ততই ব্যাপকতর হতে থাকে।


শয়তানী তৎপরতার রুপঃ


* পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপুজারী সভ্যতা জাতির নৈতিক পতনকে চরম পর্যায়ে উপনীত করেছে


* সমাজতন্ত্রের নাস্তিক্যবাদী চিন্তার হামলা জাতির মৌলিক ঈমান আকীদার মধ্যে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে।


এটি যেন সূরা আরাফের ১৭ নং আয়াতে বর্ণিত শয়তানের চ্যালেঞ্জেরই বাস্তবরুপঃ


" আমি (হামলা করার জন্য) এদের (মানব জাতির) সামনে থেকে পেছন থেকে, ডান দিক থেকে বাম দিক থেকে আসবো।"


. এ অবস্থায় বৈরাগ্যবাদী চিল্লার কিছু মুসলমান আত্মরক্ষার উপদেশ দান করে, যদিও নৈতিক উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশে উন্নত নৈতিক বৃত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও তা যথেষ্ট নয়-


উদাহারণঃ-


১. মহামারী আক্রান্ত এলাকা থেকে আত্মরক্ষার্থে পলায়ন করা স্বার্থপরতার শামীল।


২. নূন্যতম পুজি হলেও তা নিয়ে ময়দানে নামা


৩. চরিত্রের মূলধনকে অনুৎপাদক না রেখে বাজারে ছেড়ে দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে? এর পরিচালনা ও দেখাশুনার জন্য যাবতীয় উপায় অবলম্বন করা উচিত। মহামারি আক্রান্ত এলাকায় জনগণের সেবা করার জন্য আমাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।"


আল্লাহর সাথে যথাযথ সম্পর্ক: উপায় ৪টি


১. পূর্ণ নিয়মানুবর্তিতা এবং আল্লাহভীতি, নত ও বিনম্ন ভাবসহ মৌলিক ইবাদত সমূহ পালন- বিশেষ করে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করতে হবে। ইবাদাতের সাথে সাথে আত্মাবিচারে অভ্যস্ত হতে হবে।


২ . কোরআন ও হাদীস সরাসরি অধ্যয়ন, সাথে ইসলামী সাহিত্যও অধ্যয়ন করতে হবে।


৩. নফল ইবাদত-নফল নামাজ (তাহাজ্জুদ), নফল রোজা, আল্লাহরপথে অর্থ ব্যয় এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা।


৪. সার্বক্ষণিক যিকির ও দোয়া।


সংগঠনের সাথে সম্পর্ক


আমাদের নিকট সংগঠন কেবল একটি স্বাভাবিক প্রয়োজনই নয় বরং আমাদের দ্বীনদারী, নৈতিকতা, আল্লাহর ইবাদত ও রাসূলের আনুগত্যের মূর্তপ্রকাশ।


১. আদেশ আনুগত্যের ভারসাম্য রক্ষা করা। (নিসা-৫৮)


২. অন্ধ আনুগত্য না করা। (মায়েদা-২)


৩. সমালোচনা সুধারণার ভিত্তিতে


৪. ব্যক্তির পরিবর্তনে আনুগত্যের পরিবর্তন না করা। (ইমরান-১৪৪)


৫. কর্মীদের তুলনায় কর্তৃত্বশীলদের দায়িত্ব অনেক বেশী নাজুক প্রকৃতির।


(ক) কোন ভেদাভেদ না করা


(গ) মাফ করে দেয়া সংশোধন করা ও তাদের জন্য দোয়া করা


(গ) বিভিন্ন বিষয়ে কর্মীদের সাথে পরামর্শ করা। (ইমরান-১৫৯)


(ঘ) স্থির সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর তার উপর একাগ্রচিত্তে অটল থাকা।


৫. (ক) চিঠি সার্কুলারকে গুরুত্ব দান


(খ) সময়মত বৈঠকে হাজির হওয়া


(গ) আল্লাহরকাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি নিয়ে কাজ করা। দলীয় চরিত্রে দুর্বলতার প্রকাশ বৃহত্তর গোনাহ এ অনুভূতি নিয়ে কাজ করা।


(ঘ) দায়িত্বানুভূতি নিয়ে কাজ করা। (আল্লাহরনিকট অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করা)।


সহযোগীদের সাথে যথাযথ সম্পর্ক: ৮টি


১. ফাসেক সংবাদ-বাহকের সংবাদে তড়িৎ সিদ্ধান্ত না নেয়া। বরং অনুসন্ধান করা। (হুজুরাত-৬)


২. ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা। (হুজুরাত-১০)


৩. কাউকে বিদ্রূপ না করা।


৪. পরস্পরের সম্পর্কে কুধারণা না করা, অবস্থা জানবার জন্য গোয়েন্দাগিরি না করা, গীবত না করা। (হুজুরাত-১২)


-সংকলিত

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৩

বইনোট | সুবহে সাদিক : আধ্যাত্মিক ও আত্মোন্নয়ন ভাবনা | আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ

বইনোট  সুবহে সাদিক : আধ্যাত্মিক ও আত্মোন্নয়ন ভাবনা  আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ
বইনোট 

সুবহে সাদিক : আধ্যাত্মিক ও আত্মোন্নয়ন ভাবনা 
আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ


লেখক পরিচিতি

আল্লামা খুররম জাহ্ মুরাদ উপমহাদেশের ইসলামি পুনর্জাগরণে এক প্রবাদ পুরুষ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এই মনীষী ১৯৭০ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ঢাকা কেন্দ্রের সচিব ছিলেন। তাঁর সাহচর্যে সমৃদ্ধ হয়েছেন ইসলামি পুনর্জাগরণে নিবেদিত অনেক দায়িত্বশীল, যারা আজ এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসলামি জাগরণে ভূমিকা রাখছেন। তাঁর প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বই ইতোপূর্বে বাংলায় অনূদিত হয়েছে এবং ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছে। মসজিদুল হারাম কমপ্লেক্স পুননির্মাণে অবদানের জন্য তাঁর সম্মানে হারাম শরিফে একটি গেটের নাম দেয়া হয়েছে ‘বাবে মুরাদ'।

বর্তমান গ্রন্থটি তাঁর ১৯৯৩ সালে যুক্তরাজ্যে তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রদত্ত কতকগুলো ভাষণের সংকলন।

অনুবাদক পরিচিতি

ড. আবু খলদুন আল-মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি, ঢাকার বারডেম একাডেমি থেকে এমফিল এবং মালয়েশিরার ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স মালয়েশিয়া থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে এ পর্যন্ত তাঁর বিশটিরও বেশি মৌলিক গবেষণা মূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ইসলাম সম্পর্কে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাতটি।

ড. শারমিন ইসলাম মাহমুদ ২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স মালয়েশিয়া থেকে মেডিকেল এথিক্স এ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্নাস ও মাস্টার্স পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তিনি দুটো স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। বর্তমানে তিনি নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। Ethics এর উপর তাঁর মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ IIIT, USA থেকে প্রকাশিত হয়েছে।


মূল বই

প্রথম অধ্যায়: আত্মোউন্নয়নের পদ্ধতি

জীবনের লক্ষ্য
জান্নাতের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ
আপনার মিশন
তাযকিয়া অর্জনের পূর্বশর্ত;
১.তাযকিয়া-আপনার ব্যক্তিগত দায়িত্ব
২.নিখাদ প্রচেষ্টা 
৩.সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি
৪.আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভরতা 
৫.সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার 
৬.তাযকিয়া-একটি সার্বিক প্রক্রিয়া 
আশীর্বাদ ও সুফল

প্রথম অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

একজন মুসলমানের জন্য জীবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বেহেশত অর্জন। আর এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী, আজীবন স্থায়ী প্রক্রিয়া যা যে কোনো মুহূর্তেই শুরু করা যায়। এই লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ় ইচ্ছাই এই কাজের উপায় বাৎলে দেয় এবং লক্ষ্য অর্জনে গতি সঞ্চয় করে।

আত্মউন্নয়নের লক্ষ্যে আপনার আদর্শ হচ্ছে স্বয়ং রসুল মুহাম্মদ সা.। আর এই লক্ষ্যে এগুতে হলে আপনার দায়িত্বশীল আপনাকেই হতে হবে। আপনার মাঝে প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি জাগ্রত করতে হবে। আপনার দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হতে এবং প্রয়োজনীয় চেষ্টা নিয়োজিত করতে হবে। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে জীবনের সব কাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। আরও মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত প্রতিটি বৈধ কাজই তাযকিয়া অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা তাঁর ক্ষমার গুণে আমাদের ছোট-ছোট ভুলগুলোকে মাফ করে দিতে পারেন এবং আল্লাহ তায়ালার এই দয়া বা ক্ষমালাভ আমাদের বেহেশত গমনের পূর্বশর্ত।

আর যে লোক নিজের খোদার সম্মুখে দাঁড়ানোর ভয় করেছিল এবং প্রবৃত্তির খারাপ কামনা-বাসনা হতে বিরত থেকেছিল, জান্নাতই হবে তার ঠিকানা (সূরা নাযিয়াত, ৭৯ ৪০-৪১)।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাঁর সফল এবং পরিশুদ্ধ বান্দাদের মাঝে শামিল হওয়ার তৌফিক দান করুন কেন না, প্রকৃত পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি তো আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকেই দান করবেন (যারা এই পবিত্রতা ও শুদ্ধি পায় না) তাদের প্রতি এক বিন্দু পরিমাণ জুলুম করা হয় না (সুরা নিসা, ৪:৪৯ ) ।

আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ এবং তাঁর দয়া যদি তোমাদের উপর না থাকতো তাহলে তোমাদের মধ্যে কেউই পাক পবিত্র হতে পারতো না। বরং আল্লাহ তায়ালাই যাকে চান পরিশুদ্ধ করে দেন। আর আল্লাহ তায়ালাই সর্ব-শ্রোতা সর্বাধিক শুনেন ও সর্বাজ্ঞে (সুরা নূর, ২৪ : ২১)।


দ্বিতীয় অধ্যায়: জিকিরপূর্ণ জীবন

জিকিরের তাৎপর্য জিকিরের অর্থ
জিকিরের পদ্ধতি
সদা-সর্বদা আল্লাহ তায়ালার স্মরণ
জিকিরের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কর্মসূচি
জিকিরের ব্যক্তিগত পন্থা
সালাত (নামাজ)
মনস্তাত্বিক ও মানসিক প্রস্তুতি
শারীরিক প্রস্তুতি
সঠিক নিয়মে নামাজ আদায়
তাহাজ্জুদ নামাজ
সিয়াম (রোজা)
আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা পূরণ
ইচ্ছাশক্তি
শয়তান থেকে আত্মরক্ষা
কুরআন তেলাওয়াত/অধ্যয়ন
 কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি
কুরআন : আপনার নিত্যসাথী
সামষ্টিক জিকিরের পন্থাসমূহ
সত্যপন্থীদের সঙ্গ অনুসন্ধান
মানবতার সামনে সত্যের সাক্ষ্য হওয়া
আপনার জিকিরকে সংগঠিত করুন

দ্বিতীয় অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আপনার চূড়ান্ত সাফল্য ও মুক্তি নির্ভর করছে আপনার আত্মার পরিশুদ্ধির উপর। আত্মার পরিশুদ্ধির চাবিকাঠি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার জিকির।
আপনি একদিকে সার্বক্ষণিক এবং অব্যাহতভাবে অন্তরে আল্লাহ তায়ালা সচেতনতা জাগ্রত করে প্রতিদিনের সকল কথা এবং কাজকে নিয়ন্ত্রিত করুন। অন্তরে এই চেতনা বদ্ধমূল করুন যে, আল্লাহ তায়ালা সব সময় আমাদের দেখছেন, সকল কথা কাজ এবং চিন্তার খবর রাখছেন, আমাদের সকল সম্পদ আসলে তাঁরই মালিকানাভুক্ত, তিনি এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং সর্বোপরি আপনাকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে জবাবদিহির জন্য। অপরদিকে আপনি ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে কিছু সুনির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করুন। এই পন্থাগুলোর নিয়মিত সুসংগঠিত এবং আন্তরিক চর্চা ইনশাআল্লাহ আপনাকে সার্বক্ষণিক আল্লাহ তায়ালার স্মরণসম্পন্ন এক জীবন উপহার দেবে ।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রায়ই বেশি বেশি করে তার স্মরণ করার তৌফিক দিন। আমাদের অন্তর আল্লাহ তায়ালার স্মরণে প্রশান্তি লাভ করুক।


তৃতীয় অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত হওয়া

আল্লাহ তায়ালাকে দৃঢ়ভাবে ধারণের বৈশিষ্ট্য
আল্লাহ তায়ালার শুকুরগুজার হওয়া
আল্লাহ তায়ালার ইবাদত
ইবাদতে আন্তরিকতা 
আল্লাহ তায়ালার প্রেম
আল্লাহ তায়ালার পথে হানিফ হওয়া
জিহাদ-আল্লাহ তায়ালার পথে সংগ্রাম
আল্লাহ তায়ালার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার পথে বাধা সমূহ:
ক. অহংকার
খ. মোনাফেকি
গ. হতাশাবাদ
ঘ. অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ
ঙ. জিহবার অপব্যবহার
চ. যৌন লালসা

তৃতীয় অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

সহজ সরল পথে (সিরাতুল মুস্তাকিম) চলার জন্য কুরআন কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে, দৃঢ়ভাবে আল্লাহ তায়ালার রজ্জুকে ধারণ করা।

আল্লাহ তায়ালার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার মানে হচ্ছে আপনি আপনার সকল অর্জনের জন্য শুধুমাত্র তাঁরই হামদ ও শুকর করবেন, শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করবেন, পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে আল্লাহ তায়ালাকে বেশি ভালোবাসবেন, শুধুমাত্র তাঁর জন্য সংগ্রাম করবেন এবং হানিফ হতে চেষ্টা করবেন।

একই সাথে আল্লাহ তায়ালার রজ্জু ধারণের বাধা গুলোর কথা খেয়াল রাখবেন, এগুলো হচ্ছে গর্ব, শঠতা, হতাশা, অনিয়ন্ত্রিত রাগ, জিহ্বার (কথা) অসংযত ব্যবহার এবং অননুমোদিত যৌন লালসা।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেদায়াতের পথে চালিত করুন, কারণ তিনি যাকেই চান তাকেই হেদায়াতের পথে চালিত করেন ( সুরা ইউনুস, ১০ : ২৫)।


চতুর্থ অধ্যায়: আল্লাহর রসুলের সা. সাথে সম্পর্কিত হওয়া

মু'মিনের জীবনে সুন্নাহর গুরুত্ব
রসুল সা.-এর মিশন
সুন্নাহ অধ্যয়নে দিক-নির্দেশনা
পশ্চিমা সমাজের প্রেক্ষাপটে সুন্নাহ
সুন্নাহ শব্দের প্রকৃত অর্থ
আপনার মিশন

চতুর্থ অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আমাদের জীবনে অনুকরণীয় মডেল হিসেবে রসুলকে সা. সবার আগে এবং সবার উপরে স্থান দিতে হবে। আমাদের সকল ভালোবাসা সবার উপরে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসুলের জন্য নির্দিষ্ট রাখতে হবে।

মানুষের সামনে আল্লাহ তায়ালার খলিফা হিসেবে তাঁর শেষ নবির সা. বাণী পৌঁছে দেওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আমাদের কথা, কাজ, কর্তব্যনিষ্ঠা, দয়া ও ভালোবাসার গুণের মাধ্যমে আমাদের সকল সহকর্মী, প্রতিবেশীকে বুঝাতে হবে ইসলাম কি? এবং রসুল সা.-এর মিশন কি?

অবএব এই কাজে রসুল সা.-এর দয়ার গুণ অনুসরণে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাঁর গুণ অর্জনের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত সুন্নাহ্ শেখাতে সক্ষম হবো। তখনই সম্ভবত আমাদের এই পৃথিবীর জীবন শুধুমাত্র মুসলমান সমাজের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হয়ে দেখা দিবে।


পঞ্চম অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার পথে ব্যয়

দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয়
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ব্যয়
ছোট-ছোট দান
দানের ধরন
দুনিয়াপ্রীতি
অন্যদের ক্ষমা করা

পঞ্চম অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আপনি যাই খরচ করতে পারেন তা খরচ করুন আপনার পরিবারের ভরণপোষণে এবং দরিদ্রদের কল্যাণে। ইসলামের প্রয়োজনে দান করতে আরও উদার ও মুক্তহস্ত হোন। মনে রাখবেন ইসলামের পথে খরচের এখনই সময়। আপনার হাতের সব ধরনের সম্পদের ব্যবহার করুন; আপনার সময়, মনোযোগ, হৃদয়, মন, বাচনভঙ্গি, লেখনি, যুক্তি, বুদ্ধি, যা কিছু আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দিয়েছেন তা তাঁরই দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত করুন। দুনিয়ার প্রেম যেন আপানাকে গ্রাস না করে, আল্লাহ তায়ালার দয়া ও ভালোবাসা পেতে চাইলে মানুষকে ক্ষমা করতে শিখুন, তাদের প্রতি দয়ালু হোন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে নয় বরং দুনিয়াপ্রীতি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করুন। তিনি আমাদের যে নেয়ামত বা সম্পদ দিয়েছেন তা তাঁর পথে ব্যয় করার তৌফিক দিন।

ষষ্ঠ অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সাথে সম্পর্ক

আমলের রেজিস্ট্রার
পরিবারের প্রতি দায়িত্ব
সন্তানের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
মালিক ও শ্রমিকের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য
জীবজন্তুর অধিকার

ষষ্ঠ অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

সকল সৃষ্টজীব আল্লাহ তায়ালার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালাবাসেন যারা তাঁর পরিবারের সদস্যদের দয়া ও সেবা করেন। অন্যের প্রতি মামাদের দায়িত্ব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, ব্যক্তির হক নষ্ট করার কোনো ক্ষমা নেই।

আপনার নিজের প্রয়োজন পূরণের পর আপনার প্রথম দায়িত্ব আপনার পরিবারের প্রতি। বস্তুত আল্লাহ তায়ালার পর আপনার উপর সবচাইতে বড় দায়িত্ব আপনার পিতা-মাতার প্রতি। আপনার স্ত্রী/স্বামীর প্রতি আপনার দায়িত্ব পূরণ করুন এবং আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে আপনার সন্তানদের যত্ন নিন। আপনার পার্শ্ববর্তী মুসলিমের প্রতি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে মনে রাখবেন যে, ইমানের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে কাউকে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ভালোবাসা । উদ্যোক্তা (মালিক) হিসেবে সব সময় মনে রাখবেন যে আপনার অধীনস্থ কর্মচারীর উপর আপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। একইভাবে কর্মচারী (শ্রমিক) হিসেবেও আপনার দায়িত্ব হচ্ছে আপনার কাজ দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে করা।

আখেরাতে আপনার ভাগ্য আরও নির্ধারিত হবে এটার ভিত্তিতে যে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে আপনার প্রতিবেশীর উপর দায়িত্ব আপনি কীভাবে পালন করেছেন। রসুল সা. অমুসলিমদের প্রয়োজনের দিকে সবসময় বিশেষ খেয়াল রাখতেন, এমনকি মুসলিম সমাজের দারিদ্র সত্ত্বেও।

জীব-জানোয়ারেরও অধিকার আছে, কারণ তারাও আল্লাহ তায়ালার পরিবারভুক্ত। আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন সেই সব প্রাণীর স্বার্থের বিষয়ে যারা কথা বলতে পারে না। তাদের উপর আরোহন করুন যখন তারা সুস্থ এবং তাদের গোশতও খাবেন যখন তারা সুস্থ্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে সক্ষম ও সচেতন করুন।

সপ্তম অধ্যায়: আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাৎ

জীবনের লক্ষ্য
পরকালের বাস্তবতা
মৃত্যু নিশ্চিত ও অনিবার্য 
মানুষের পরকাল ভুলে যাওয়ার প্রবণতা
আল্লাহ তায়ালার দয়া অন্বেষণ
আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা অনুসন্ধান
আত্মসমালোচনা
মৃত্যুভয় জয় করা
 
সপ্তম অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ

আমাদের জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা। এটা হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যা আমাদের আজই এবং এখনই নিতে হবে। এই একটি সিদ্ধান্ত আমাদের গোটা জীবনের চলার দিক ও লক্ষ্যের নির্দেশনা দেবে। যে পথের কথা বলা হয়েছে কুরআনে, যে পথে চলার উদাহরণ রেখে গেছেন মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা.।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের যে জ্ঞান দিয়ে ধন্য করেছেন তাই হবে আমাদের এ পথে চলার সহায়ক। আমাদের মিশন যখন সফল হবে তখন আমরা দেখবো আমাদের দোয়ার জবাব আল্লাহ তায়ালা দিচ্ছেন, আমাদের প্রয়োজনে তাঁর সাহায্য ও মদদ পাচ্ছি ঠিক যেমনটি তিনি বলেছেন :

হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার অনুগত বান্দাদের মধ্যে শামিল হও আর আমার বেহেশতে প্রবেশ করো (সুরা ফজর, ৮৯ : ২৭-৩০)।



(পূর্ণাঙ্গ নোট চলমান)

বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০২৩

বইনোট: ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক | লেখক: খুররম জাহ মুরাদ

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক

খুররম জাহ্ মুরাদ

☆ লেখক পরিচিতি:
- নাম : ইঞ্জিনিয়ার খুররম জাহ্ মুরাদ
- পিতার নাম : মঞ্জুর আলী মুরাদ
- মাতার নাম : বেগম আনতুল হাই
- ১৯৩২ সালের ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালে
MED ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, করাচী থেকে গ্রাজুয়েশন
- যুক্তরাষ্ট্রের ভিনেটা ইউনিভার্সিটি থেকে সিভিলে পোস্ট গ্রাজুয়েশন
- ইসলামী জমিয়তে তালাবা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন
- ১৯৫৭ সালে ACE (Associate Council Engineer) এর এমডি হিসেবে বাংলাদেশে আসেন
- ১৯৬০-৭০ পর্যন্ত তিনি ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন
- ১৯৭০ সালে লন্ডনের দাওয়াতুল ইসলাম ট্রাস্টে যোগদান করেন
- কাবা শরীফের সম্প্রসারণ কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন এবং তার নামে কাবা শরীফে বাবে খুররম মুরাদ নামে একটি দরজা আছে
- ১৯৯৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।


☆ প্রাথমিক কথাঃ

    ঐতিহাসিকভাবে একথা সত্য যে, প্রাক ইসলামী যুগে মানুষে মানুষে কোন ভাতৃত্বের বন্ধন ছিলনা। বিভিন্ন গোত্র, দল, খান্দানে বিভক্ত ছিল। ছিল পরস্পরের রক্ত পিপাসু ও জানমাল ইজ্জতের দুশমন। এমতবস্থায় শত্রুতা ভুলে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বের মহান শিক্ষা দিয়েছিল হযরত মুহাম্মদ (সা)।
    যার প্রভাবে সর্বকালের সবচেয়ে বিশৃঙখল জাতি সর্বশ্রেষ্ট জাতিতে রূপান্তরিত হতে পেরেছিল। প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল একটি আদর্শ রাষ্ট্র, আর তা সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের সুস্পষ্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সুতরাং বলা যায় ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এমন একটি ঔষধ তথা পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধের জাগরণ অতিব প্রয়োজন।


☆ মৌলিক আলোচনাঃ

প্রকৃত পক্ষে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে তিনটি

১. প্রয়োজনীয় গুনাবলী
২. ধ্বংস ও দুর্বলকারী উপাদান এবং তা থেকে বাঁচার উপায়
৩. যে সমস্ত গুণাবলী সম্পর্ককে মজবুত ও উন্নত করে


☆ বইটির ৪টি ভাগে রয়েছেঃ
    ১. পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি, তার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
    ২. চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা ও তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য
    ৩. সম্পর্ককে বিকৃতি থেকে রক্ষা করার উপায়
    ৪. সম্পর্ককে দৃঢ়তর করার পন্থা।



১. পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি তার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

১. সম্পর্কের ভিত্তি ও মর্যাদা
(ক) সম্পর্কের প্রকৃতি
(খ) ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের সম্পর্ক একটি আদর্শিক সম্পর্ক
(গ) এটা কোন হালকা বা ঠুনকো সম্পর্ক নয়। গভীর ও প্রগার ভালবাসা এবং স্থিতিশীলতার সমন্বয়ে রচিত।

২. ভ্রাতৃত্ব ঈমানের অপরিহার্য দাবি
(ক) পারস্পরিক সম্পর্কের উপর গোটা জীবন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এজন্য ঈমান মুমিনদেরকে সকল মানুষদের সাথে সাধারণ ভাবে এবং পরস্পরের সাথে বিশেষ ভাবে সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দেয়।
(খ) আর এ সম্পর্ককে আদল ও ইহসানের উপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার দিক নির্দেশনা দেয়।

৩. বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবের জন্য ভ্রাতৃত্ব অপরিহার্য
(ক) ঈমানের লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি
(খ) বিপ্লবের জন্য একটি সুদৃঢ়, স্থিতিশীল ও ভ্রাতৃত্বসূলভ সম্পর্ক অপরিহার্য।
(গ) এ সম্পর্কের প্রকৃতি হবে শীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায়।

৪. ভ্রাতৃত্বের দাবি তার গুরুত্ব ও ফলাফল
(ক) ভ্রাতৃত্বের দাবি হচ্ছে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, রহমত ও ভালবাসার সম্পর্ক
(খ) ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব, রাসুলের বানী-“তোমরা ততোক্ষণ পর্যš Íমুমিন হবে না, যতোক্ষণ না পরস্পরকে ভালোবাসবে” (মুসলিম-আবু হুরায়রা)
(গ) ভ্রাতৃত্বের ফলাফল-  ঈমান পূর্ন হবে  আখেরাতের সফলতা

৫. আখিরাতে ভ্রাতৃত্বের সুফল
(ক) আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন কারীরা আরশের ছায়াতলে থাকবেন
(খ) সম্পর্ক স্থাপন কারীদের জন্য নূরের মিম্বর তৈরি হবে।

৬. পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব
(ক) কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য এক ঈমানের ভিত্তিতে পারস্পরিক ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন ইসলামী আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ন
(খ) পারস্পরিক সম্পর্কের বিকৃতি গোটা দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।


২. চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা ও তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য

১. কল্যান কামনা-
কল্যাণ কামনার প্রকৃতি মানদন্ড হচ্ছে যে, মানষ নিজের জন্য যা পছন্দ করবে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে। তাই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ পরস্পরকে ভালবাসবে এবং কল্যাণ কামনা করবে যে রুপ সহোদর ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করা হয়।

২. আত্মত্যাগ
একজন মুসলমান তার ভাইয়ের জন্য শুধু নিজের পছন্দই করেনা বরং নিজের উপর অগ্রাধিকার দেয়। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ নিজের প্রয়োজনকে মুলতবী রেখে অপরের প্রয়োজন মেটাবেন।

৩. আদল (সুবিচার)
ক) লোকদের অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা ও ভারসাম্য কজায় রাখা
খ) প্রত্যেকের অধিকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।

৪. ইহ্সান (সদাচরণ)
ক) ইহসান অর্থ হল সম্পর্কের সৈান্দর্য ও পূর্নতা দান করা।
খ) সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদল যদি অপ্রীতি ও তিক্ততা থেকে রক্ষা করে তবে ইহসান তাতে মাধুর্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করে।

৫. রহমত
ক) রহমতের এ গুণই ব্যক্তিকে জনপ্রিয় করে তোলে এবং সাধারণ লোকদেরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে।
খ) রাসুলের বানী- “যারা রহম করে, রহমান তাদের প্রতি রহম করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীর প্রতি রহম করো, যেন আসমানবাসী তোমাদের রহম করেন।”

৬. মার্জনা
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ পরস্পর একে অন্যের দোষত্রুটি মার্জনা করবে। কারণ যারা দুনিয়ার জীবনে ক্ষামা করে দেবেন। তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। তাদেরকে আল্লাহতায়ালার ক্ষমা ও মার্জনার তীতি গ্রহণ করা উচিৎ।

৭. নির্ভরতা
মোমিনগন একে অন্যের উপর যেন নির্ভর করতে পারে। অর্থাৎ তার সমস্ত গোপন বিষয়াদির ব্যাপারেও পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে প্রকাশ করতে পারে অন্যের কাছে। আর এটাই হল ভ্রাতৃত্বের দাবি।

৮. মূল্যোপলব্ধি
মানুষ তার এ সম্পর্কের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে এতটুকু অবহিত হবে, যাতে করে এর সঠিক মূল্যটা সে উপলব্ধি করতে পারে। আর এটা তখনি সম্ভব হবে যখন সে কোন μমেই তার এ সম্পর্ক ছিন্ন করতে সম্মত হবেনা।


৩. সম্পর্ককে বিকৃতি থেকে রক্ষা করার উপায়

১. অধিকারে হস্তক্ষেপ-
একজন মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে তার ভাইয়ের অধিকারের মধ্যে কোন একটি অধিকার ও হরণ করার অপরাধ যাতে সে অপরাধ না হয় তার প্রতিকারের দিকে দৃষ্টি রাখা। রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কসম খেয়ে কোন মুসলমানের হক নষ্ট করেছে, আল্লাহ নিঃসন্দেহে তার প্রতি জাহান্নামকে অনিবার্য এবং জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন।

২. দেহ ও প্রানের নিরাপত্তা-
কোন মুসলিম ভাইয়ের দেহ প্রাণের নিরাপত্তার জন্য একজন অন্যের জন্য সর্বদা প্রস্তত থাকবে। । রাসুল (সা.) বলেন, “মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী আর তার সঙ্গে লড়াই করা হচ্ছে কুফরী।” (বুখারী, মুসলিম)

৩. কটুভাষা ও গালাগাল -
কোন ভাইকে সাক্ষাতে গালাগাল করা তার সঙ্গে কটু ভাষায় কথা বলা এবং ঠাট্রা বিদ্রুপ করা সম্পূর্ন নাজায়েজ। রাসুল (সা.) বলেন, “কোন কটুভাষি ও বদ স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তি জান্নাত প্রবেশ করবেনা।”

৪. গীবত -
গীবত হচ্ছে মানুষ তার ভইয়ের সামনে নয় বরং তার পেছনে বসে নিন্দা করা।

৫. ছোগলখোরী -
গীবতের একটি বিশেষ রূপ হল ছোগলখোরী। রাসুল (সা.) বলেন, “ছোগলখোর জান্নতে যাবেনা।”

৬. শরমিন্দা করা .-
আপন ভাইকে তারা সাক্ষাতে বা অন্য লোকের সামনে তার দোষত্রুটি জন্য লজ্জা দেওয়া এবং এভাবে অপমাননা করা শরমিন্দার অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি তার ভাইকে তার গুনাহের জন্য লজ্জা দিল তার দ্বারা সেই গুনাহ কাজ না হওয়া পর্যন্ত সে মৃত্যুবরণ করবেনা।” রাসুল (সা.) আরো বলেন, “তাদেরকে কোন দোষ বা গুনাহের লক্ষ্য বানিয়ে শরমিন্দা ও অপমানীত করেনা।”

৭. ছিদ্রান্বেষণ -
কোন ভাইয়ের দোষত্রুটি খুজে বেড়ানোই ছিদ্রান্বেষণ করা। । রাসুল (সা.) বলেন, “মুসলমানদের দোষ খুঁজে বেড়িয়োনা। কারণ, যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ ও গুনাহ খুঁজতে থাকে, আল্লাহতার গোপন দোষ ফাঁস করতে লেগে যান। আর আল্লাহযার দোষ প্রকাশ করতে লেগে যান, তাকে তিনি অপমান করেই ছাড়েন-সে তার ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকুক না কেন।”

৮. উপহাস করা -
ঠাট্রা বিদ্রুপের মাধ্যমে একে অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করা। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, “হে ঈমানদারগণ, কোন সম্প্রদায় অপর কোনো সম্প্রদায়কে ঠাট্রা করোনা, সম্ভবতঃ সে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ হবে। আর কোন নারী অপর কোন নারীকে ঠাট্রা করো না, সম্ভবত সে শ্রেষ্ঠ হবে তার চাইতে।” (সুরা হুজরাত ১১)

৯. তুচ্ছ জ্ঞান করা .-
অপর ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করা মারাত্মক গুনাহের কাজ। রাসুল (সা.) বলেন, “কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে রা অপমান করবে আর না তুচ্ছ জ্ঞান করবে।”

১০. নিকৃষ্ট অনুমান .-
প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছাড়া কোন মুসলমান যদি তার ভাই সম্পর্কে অহেতুক সন্দেহ করে তবে তাহাই নিকৃষ্ট অনুমান। অনুমান করে কথা বলা গুনাহের কাজ। এ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, “হে ঈমানদারগন, বহু অনুমান থেকে তোমরা বেঁচে থাকো, নিঃসন্দেহে কোন-কোন অনুমান হচ্ছে গুনাহ।” (সুরা হুজরাত ১২)
রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা অনুমান পরিহার করো, কেননা অনুমান হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা কথা।” (বুখারী,মুসলিম; আবু হুরায়রা রা.)

১১. অপবাদ .-
গীবতের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ হল অপরের কাছে এক ভাই সম্পর্কে মিথ্যা বলা যে দোষ এর মধ্যে সে নেই। এ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, “যারা মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে কষ্ট দেয়, তারা আপন মাথায় ‘বুহ্তান’ ও স্পষ্ট গুনাহ চাপিয়ে নিলো।” (সুরা আহযাব. ৫৮)

১২. ক্ষতিসাধন .-
মুমিনদের লক্ষ্য রাখা অতিব প্রয়োজন যে, তার দ্বারায় যেন অন্যের ক্ষতি সাধন না হয়। হাদিসে ক্ষতি সাধন কারীকে অভিশপ্ত বলা হয়েছে।

১৩. মনোকষ্ট .-
মুসলমানদের অবশ্যই চলা-ফেরা, কথা-বার্তায় সতর্ক থাকতে হবে যে, তার দ্বারা যেন কেউ মনোকষ্ট না পায়। কারণ এর দ্বারা সম্পর্ক নষ্ট হয়।

১৪. ধোকাঁ দেওয়া .-
কথা বার্তা বা লেনদেনে আপন ভাইকে ধোঁকা দেয়া বা মিছে কথাবলা সম্পর্কে মুসলমানদেরকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, “সব চাইতে বড় খিয়ানত হচ্ছে এই যে, তুমি তোমার ভাইকে কোনো কথা বললে সে তোমাকে সত্যবাদী মনে করলো; অথচ তুমি তাকে মিথ্যা কথা বললে।” (তিরমিযী; সুফিয়ান বিন আসাদ)

১৫. হিংসা .-
হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা এক ঘৃণ্য ব্যাধি। এই মারাত্মক ব্যাধির প্রভাবে লোকদের ঈমান বিপন্ন হয়ে পড়ে। হিংসার মূলে কতগুলো জিনিস থাকে। যেমন বিদ্বেষ, শত্রুতা, ব্যক্তিগত অহমিকা, অপরের সর্ম্পকে হীনমন্নতা অপরকে অনুগত করার প্রেরনা ইত্যাদি। রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক । কারন আগুন যেমন লাকড়িকে খেয়ে ফেলে, হিংসা ঠিক তেমনি নেকী ও পুণ্যকে খেয়ে ফেলে।”


৪. সর্ম্পকে দৃঢ়তর করার পন্থা

১. মান ইজ্জতের নিরাপত্তা .-
এক মুসলমানের জন্য আরেক মুসলমানের মান ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সম্ভব হলে আন্তরিকতা গড়ে উঠে।

২. দুঃখ কষ্টে অংশগ্রহণ .-
মুমিণগন হচ্ছে একটি দেহ। দেহের এক অংশে যদি আঘাত প্রাপ্ত হয়। তবে অন্য অংশ ও তেমন কষ্ট অনুভব করে। ঠিক তেমনি এক মুসলমান অপর মুসলমানের দুঃখ কষ্টে শরীক থাকবে।

৩. সমালোচনা ও নসীহত .-
নিজের দোষ একটি নিজের চোখে ধরা পড়েনা। তাই মুমিনগন একে অপরকে গঠন মুলক সমালোচনা ও নছিহতের মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে এক মুসলমান অপর মুসলমানের আয়না স্বরূপ।

৪. মোলাকাত .-
একতা সত্য যে পরস্পর অধিক সাক্ষাতের ফলেই এক জন মানুষের সাথে আরেক জন মানুষের বন্ধন টিকে থাকে। সুতারাং মোলাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম।

৫. রুগ্ন ভাইয়ের পরিচর্যা .-
কোন ব্যক্তি যদি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে তবে তার সেবা শুশ্রুসার প্রয়োজন হয়। ফলে বন্ধুত্বের বন্ধন আরো দৃঢ হয়। রাসুল (সা.)বলেন “যখন সে রোগাক্রান্ত তাকে সেবা কর ”।

৬. আবেগের বহি.প্রকাশ .-
কোন মানুষের মধ্যে কারো প্রতি প্রেম ভালবাসা থাকলে তা আবেগের মাধ্যমে বহি.প্রকাশ পাবে। এভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।

৭. প্রীতি ও খোশ-মেজাজের সাথে মুলাকাত .-
পরিচ্ছন্ন মন দিয়ে সাক্ষাতে কথা বলার সময় মিষ্টি কথা বলার এবং ঠাট্রা বিদ্রুপ ও উপহাস থেকে দূরে থাকা। রাসুল (সা.) বলেছেন, “নেক কাজের ভেতর কোনোটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করো না, যদি তা আপন ভাইয়ের সাথে তোমার হাস্যোজ্জ্বল সাক্ষাৎ করার তূল্যও হবে।” (মুসলিম; আবু যর রা.)

৮. সালাম .-
পারস্পরিক সর্ম্পক বৃদ্ধিতে সালামের বিকল্প নেই। সালামের মাধ্যমে অন্ধকার দূরীভূত হয়। এজন্য রাসুল (সা.) বলেন, “পারস্পর সালাম বিনিময় কর।”

৯. মুছাফাহ .-
মুছাফাহর মাধ্যমে পারস্পরিক ভালোবাসা ও হৃদয়াবেগ প্রকাশের দ্বিতীয় মাধ্যম। অর্থাৎ সালামের গোটা ভাবধারাই এদ্বারা পূর্নতাপ্রাপ্ত হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, “মুছাফাহার দ্বারা তোমাদের পারস্পরিক সালামের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে।” (তিরমিযী; আবু উমালাহু রা.)

১০. উৎকৃষ্ট নামে ডাকা .-
কাউকে তার পছন্দনীয় ভাষায় সম্বোধন করলে সে খুশী হয়। আন্তরিকতা চলে আসে। পক্ষান্তরে উপনামে বা বিকৃত নামে ডাকলে মন খারাপ করে সম্পর্ক নষ্ট হয়।

১১. ব্যক্তিগত ব্যাপারে ঔৎসুক্য .-
আন্তরিক ভালোবাসার একটি অন্যতম তাকিদ হচ্ছে, নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারের ন্যায় আপন ভাইয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও ঔৎসুক্য পোষণ করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, “এক ব্যক্তি যখন অন্য ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, তখন তার কাছে থেকে তার নাম, তার পিতার নাম এবং তার গোত্র-পরিচয় জিজ্ঞেস করে নিবে। কারণ এরদ্বারা পারস্পরিক ভালোবাসার শিকড় অধিকতর মজবুত হয়।” (তিরমিযী, ইয়াজিদ বিন নাআমাহ রা.)

১২. হাদীয়া .-
সম্পর্ক বৃদ্ধির অতি উত্তম পন্থা হল মাসে মাসে উপহার দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেছেন, “একে অপরকে হাদিয়া পাঠাও, এরদ্বারা পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে এবং হৃদয়ের দূরত্ব ও শত্রুতা বিলীন হয়ে যাবে।” (মুয়াত্তা মালিক; আত্বা)

১৩. শোকর-গোজারী .-
অপরের ভালোবাসা উপলব্ধিকে প্রকাশ করার জন্যে শোকর-গোজারী হচ্ছে একটি উত্তম পন্থা। রাসুল (সা.) বলেছেন, “কেউ যখন তাঁর খেদমতে কিছুপেশ করতে তিনি শুকরিয়ার সাথে তা গ্রহণ করতেন এবং কেউ তার কোন কাজ করে দিলে সেজন্যে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।

১৪. একত্রে বসে আহার .-
আন্তরিকতা, ভালবাসা প্রকাশের একটি চমৎকার পন্থা হল একত্রে বসে আহার করা। নবী কারীম (সা.)-এর কাছে কোন খাবার জিনিস থাকলে অথবা কোথাও থেকে কিছু আসলে তিনি গোটা মজলিসকে তাতে শরীক করতেন।

১৫. দোয়া .-
একজন আরেকজনের জন্য দোয়া করলে যদি সে ব্যক্তি তা দেখতে পায় তবে সে মুগ্ধ হয়। তভাবে আলাহর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।

১৬. সুন্দরভাবে জবাব দেয়া .-
পারস্পরিক কথা বার্তায় কোন প্রশ্নের জবাব সুন্দর ভাবে দেয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, “দুইজন প্রেমিকের মধ্যে সেই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ, যে তার ভাইয়ের প্রতি অধিক ভালোবাসা পোষণ করে।”

১৭. আপোষ রফা এবং অভিযোগে খন্ডন .-
কোন ব্যাপারে মনো মালিন্য হলে আপোষে করে নেয়া এবং অভিযোগ খন্ডন করা। অভিযোগ থেকে বাচতে হলে করনীয়-
প্রথমতঃ অভিযোগের সুযোগ না দেওয়া,
দ্বিতীয়তঃ দরাজদিল হওয়া উচিত,
তৃতীয়তঃ অভিযোগ লালন না করে তার ভাইয়ের নিকট প্রকাশ করা উচিত,
চতুর্থতঃ অভিযোগে অসন্তুষ্ট না হয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত,
পঞ্চমতঃ অভিযোগ জানবার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মসংশোধনের চেষ্টা করা,
ষষ্ঠতঃ অভিযোগ স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে কোনরূপ কার্পন্য না করা।

১৮. প্রভুর কাছে তাওফিক কামনা .-
বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক হচ্ছে ঈমানের একটি বুনিয়াদী শর্ত। একজর ভাই আরেকজন ভাইয়ের জন্য আলাহর নিকট বিনীতভাবে মুনাজাত করা উচিত। আলাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, “হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এবং আমাদের সেই সব ভাইকে ক্ষমাদান কর যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে এবং আমাদের দিলে ঈমানদার লোকদের জানে কোন হিংসা ও শত্রুতাভাব রেখো না। হে আমদের প্রভু! তুমি বড়ই অনুগ্রহ সম্পন্ন এবং করুণাময়।”