Close
আলোচনা নোট লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
আলোচনা নোট লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

একুশ শতকের এজেন্ডা || আবুল আসাদ



একুশ শতকের এজেন্ডা
আবুল আসাদ

অস্তায়মান বিশ শতকের উপসংহার থেকেই গড়ে উঠবে একুশ শতকের যাত্রাপথ। তাই এই উপসংহারের স্বরূপ সন্ধান খুবই জরুরী। আমেরিকান এক লেখক তার এক শতাব্দী-সিরিজ গ্রন্থে শতাব্দীর 'Mega Trend' গুলোকে তার মত করে চিহ্নিত করেছেন। এই 'Mega Trend' গুলোর মধ্য রয়েছেঃ

১. বিশ্ব অর্থনীতি
২. বিশ্ব রাজনীতি
৩. বিশ্ব সংস্কৃতি

এই 'Mega Trend' গুলো বিশ শতাব্দীর অনন্য কারিগরি, বৈষয়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এবং এই উন্নয়নের স্রোতে বহমান জাতিসংঘের অনন্য ভূমিকার দ্বারা প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়ে আগামী শতাব্দীর সিংহদ্বারে এক বিশেষ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই রূপের নির্ণয়ই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।

প্রথমে বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের গতি-প্রকৃতির প্রশ্ন আসে। আশির দশকের শুরুপর্যন্তবিশ্ব দুই অর্থনীতি- পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের সংঘাতে সংক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তারপর মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য গ্রাসে সমাজবাদী অর্থনীতির পতন শুরুহলো। আশির দশকের সমাপ্তিতে এসে তা সমাপ্তও হয়ে গেল। আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্রাসে গোটা পৃথিবী। মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূল কথা হলোঃ শক্তিমান অর্থনীতি বিজয় লাভ করবে, পরাজিত হবে দুর্বল অর্থনীতি। এই পরাজয়ের ভয় দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করে তুলবে এবং সেও উন্নীত হবে বিজয়ীর আসনে। তাই সবাইকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্রোতে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই তত্ত্ব কথায় উলিখিত 'আইডিয়াল সিশুয়েশন' হয়তো কোনদিন আসবে কিংবা আসবেই না। তবে তার আগেই শক্তিমান অর্থনীতির করাল গ্রাসে আত্মরক্ষার অধিকারহীন দুর্বল অর্থনীতি পরাধীন হয়ে মরার মত বেঁচে থাকার পর্যায়ে চলে যাবে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ মুক্ত বাজার অর্থনীতি গলাধঃকরণ করে ইতোমধ্যেই বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় বাজার না পাবার আশংকায় বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আসবেনা বরং তা যাবে বাজার দখলকারী দেশের পুজিপতিদের কাছে। যাওয়া শুরুহয়েছে। যে বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তা গিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর অন্যথা না ঘটলে অব্যাহত এই প্রবনতা বাংলাদেশকে শিল্প পণ্যের ক্রেতা এবং কৃষিপণ্যের বিক্রেতায় রূপান্তরিত করবে।

বলা হচ্ছে, এই বিনাশ হতে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে 'ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন' (W.T.O)। কিন্তু জাতিসংঘের মত এই সংস্থাও শক্তিমানদের দ্বারা পরিচালিত এবং শক্তিমান অর্থনীতিরই স্বার্থ পুরা করবে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থা মুক্তবাজার বাণিজ্যের বিশ্বনিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ দুর্বল অর্থনীতির বেয়াড়াপনাকে শায়েস্তা করার জন্য বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে পারবে হয়তো 'মহান' মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল্যবান স্বার্থেই।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বিশ্বরূপ বিশ্বে একক অর্থনীতি গড়ার লক্ষেই। যার নিয়ন্ত্রনে থাকবে আজকের শক্তিমান অর্থনীতিগুলো, আর শোষিত হবে অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির দেশসমূহ। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের এটাই প্রবণতা।
এই প্রবণতা তার লক্ষে পৌঁছতে পারলে, একক এক বিশ্ব অর্থনীতি গড়া এবং তাকে এককেন্দ্রীক নিয়ন্ত্রনে আনার প্রয়াস সফল হলে বিশ্বের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার অশুভ প্রভাব নেমে আসবে।


অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী মুসলিম অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় 'Mega Trend' হিসেবে আসে বিশ্ব রাজনীতির কথা।

ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার নেতৃত্ব দেবে ইহুদিরা এবং যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ আমি জানি না, তবে এক বিশ্ব অর্থনীতির মতই এক বিশ্ব রাষ্ট্র গড়ার ধীর ও ছদ্মবেশী প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিসংঘ এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয় করেছে যেমন কম্যুনিষ্ট সাম্রাজ্য, তেমনি জয় করবে গোটা বিশ্ব। বিশেষ সংজ্ঞায়িত এ গণতন্ত্রের আদর্শের কাছে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অধিকারকে বলি দিতে বলা হচ্ছে। বলি না দিলে শক্তি প্রয়াগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই হাইতিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী নামানো হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। এমন হাইতি ভবিষ্যতে আরও অনেক হতে পারে।

গণতন্ত্র কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হলো গণতন্ত্রের অর্থ ও রক্তস্রোতের উপর তাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রসংহতি গড়ে তুলেছে, সে রক্তস্রোত প্রবাহিত না হলে এবং সে সময় গণতন্ত্রের নীতি অনুসৃত হলে তাদের এই রাষ্ট্রসংহতি গড়ে উঠতো না। এমনকি রেড ইন্ডিয়ানদেরও একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো। এই ইতিহাস তারা ভুলে গেছে। যেমন আমাদের প্রতি এখন তাদের নসীহত, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর গায়ে আমাদের হাত দেয়া যাবে না। তথাকথিত আদিবাসি বলে তাদের মাটিতে আমাদের পা দেয়া যাবেনা। দেশের ভিতর কোন গ্রুপবা কোন ব্যক্তি যদি বিদেশী টাকার পুতুল সেজে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চায়, তাহলেও গণতন্ত্রের আদর্শের স্বার্থে তাদের জামাই আদর দিয়ে যেতে হবে।

গণতন্ত্রের দায়িত্বহীন এই আদর্শ অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী এবং সমস্যা পীড়িত দেশ ও জাতিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এমনকি খন্ড- বিখন্ড করতে পারে। অন্তত আর কিছু না হোক বহু মত ও পথে বিভক্ত এবং দুর্বলতো করবেই। এ ধরনের দেশ ও জাতিকে তাদের স্বকীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনায়াসেই সরিয়ে আনা যায় এবং তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর বিদেশী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে এনজিও প্রভাব। এরা নামে 'নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন' হলেও এদের সরকারি ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এখনি এরা সরকারি বাজেটের একটা অংশ পাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এরা সরকারের গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টর পরিচালনার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। তখন আইন শৃংখলা ও দেশ রক্ষা ছাড়া সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না। জাতিসংঘের অনুসৃত নীতি রাষ্ট্রসমূহের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত অথবা বিলোপ করে দিতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার কাজ অনেক আগেই শুরুকরেছে এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজেও হাত দিয়েছে। অতএব জাতিসংঘ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে সংগত কারণেই রাষ্ট্রসমূহকে দেশ রক্ষা বাহিনী খাতে খরচ বন্ধ করতে বলতে পারে। সুতরাং সরকারের কাজ তখন হয়ে দাঁড়াবে শুধু শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা এবং সরকারের এই কাজও নিয়ন্ত্রিত হবে এনজিওদের দ্বারা। কারণ এনজিওরা গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টরের মালিক হওয়ার ফলে দেশের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। আর এনজিওরা, সবাই জানেন, আর্থিক ও আদর্শগত দিক থেকে মূলত জাতিসংঘ অথবা জাতিসংঘের পরিচালক শক্তিসমুহের আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় রাষ্ট্রসমুহ কার্যতই জাতিসংঘ নামের এককেন্দ্রীক এক শক্তির অধীনে চলে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হলো জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধ বিলোপ অথবা দুর্বল করারও একটা প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে। জাতিসংঘ তার উন্নয়ন, সেবা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠামুলক এজেন্সী সমুহের মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন গড়ে তুলছে এবং পারস্পরিক নির্ভরতার এক অপরিহার্য অবস্থা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা জাতীয় চিন্তাকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিবে এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনাকে বড় করে তুলবে। জাতিসংঘের পিছনে 'নাটের গুরু' যারা, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই 'শূন্য জাতীয়বোধ' অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।


এভাবেই পৃথিবীর আজকের শক্তিমানরা জাতিসংঘের ছায়ায় দাড়িয়ে জাতিসংঘকে নতুন এক বিশ্বরূপ দিতে চাচ্ছে। জাতিসংঘের জননন্দিত সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যামার শোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘকে হতে হবে 'বিশ্ব সংস্থা', 'বিশ্ব সরকার' নয়। সে হবে উন্নয়ন ও শান্তির সহায়তাকারী। কোনক্রমেই জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন সিস্টেমের ডিক্টেশনকারী নয়। কিন্তু জাতিসংঘকে আজ রাষ্ট্রসমূহকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বের দুর্বল জাতি সমুহের মত মুসলমানদেরকেও একবিংশ শতকের এই জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

বিশ্বে এক অর্থনীতি ও এক রাজনীতির মত গোটা বিশ্বকে এক সংস্কৃতির অধীনে আনারও দুর্দান্ত প্রয়াস চলছে। এই লক্ষে দুনিয়ার মানুষের জন্য একক এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কাজ করছে। তারা চাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জন্য মূল্যবোধের একক একটি মানদন্ডনির্ধারণ করতে। এই মানদন্ডের নাম দেয়া হচ্ছে 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম'। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে যে, মানবাধিকার সকলের উর্ধ্বে। জাতীয় ধর্ম, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি অধিকার সবই এর অধীন। এই অধিকারগুলো ততটুকুই ভোগ করা যাবে, যতটুকু 'মানবাধিকার' অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের এক দলিলে এভাবে বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জীবন ও পরিচয়ের বিকাশসহ সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই স্বীকৃত। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকারকে সীমাহীন করা যাবে না। যখনই তা মানুষের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপকরে তখনই সাংস্কৃতিক অধিকার অচল হয়ে পড়ে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক অধিকার মানুষের মৌল স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। (United Nation Background Note-by Diana Ayten Shenker) এই দৃষ্টিভঙ্গিই জাতিসংঘের নাইরোবী সম্মেলন, কায়রোর জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন, কোপেন হেগেনের সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন, বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আরও হবে। উদ্বেগের বিষয় এসব সম্মেলনে সুকৌশলে প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (Secular Humanism) প্রতিষ্ঠার দলিলে অধিকাংশ মুসলিম দেশও দস্তখত করেছে। অথচ জাতিসংঘ প্রচারিত 'ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ' এর তত্ত্ব মেনে নিলে ইসলামকে কেটে ছোট বিকলাঙ্গ করে মসজিদে পুরে রাখতে হবে। তাদের বলা উচিত ছিল, তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকার আইন নিশ্চিত ভাবেই মানব জীবন, তার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষনকে বিপর্যন্ত ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। ইসলামের আদর্শ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে কার্যকরভাবে যদি মানব মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই হয় সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই কথা কেউ আমরা বলিনি।

এভাবে অন্য কেউও বলছে না, অন্য জাতি, অন্য ধর্মও নয়। তার ফলে, 'ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ'-ই বিশ্ব সংস্কৃতির একমাত্র মানদন্ডহয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্য কথায় এটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতি।

এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করতে পারবো না। উত্তরাধিকার আইনকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী, শান্তিরআইন অভিহিত হবে বর্বর বলে, পর্দাকে বলা হবে মানবাধিকারের খেলাপ, কুরবানিকে বলা হবে অপচয় ইত্যাদি। এমনকি ইসলামের দাওয়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোথাও জাতীয় আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠিত হলে তাকে অভিহিত করা হবে মানবাধিকার বিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে। 'সেকুলার হিউম্যানিজম' প্রকৃত পক্ষে সূদুরপ্রসারী একটা ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য মানুষকে তার অলক্ষ্যে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে নেয়া। মানুষের ধর্ম না থাকলে তার জাতীয়তা ধ্বসে পড়বে। জাতীয়তা ধ্বসে পড়লে তার রাষ্ট্রও ধ্বসে পড়বে। এটাই চাচ্ছে আজকের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বনিয়ন্ত্রকরা।

বিশ্বে ধর্মসমুহকে বিশেষ করে ইসলামকে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিরোধী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে একবিংশ শতকে।

বিশেষ করে ইসলামকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, অন্য ধর্মগুলোর কোনটিই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী নয়। সুতরাং তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে না, করতে চাইলেও তারা পারবে না। কিন্তু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। শুধু ইসলামই তাদের চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে পারে। ইসলামের শত্রুরাও এ কথা বলছে। The End History- এর লেখক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা কম্যুনিজমের ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার বিজয় প্রমান করছে যে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মতবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে'। কিন্তু তিনি আবার বলেছেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা একটা হবে ধর্মের সাথে আসছে একবিংশ শতাব্দীতে এবং তাঁর মতে সে ধর্ম 'ইসলাম'।

সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে, মানবতার সামনে, তার মোকাবিলা ইসলামকেই করতে হবে।

আর এ দায়িত্ব বিশ্বের মুসলমানদের। আনন্দের বিষয়, এ দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় জীবনে যে রেনেসাঁর প্রয়োজন সে রেনেসাঁ আজ সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম বিশ্বে। রেনেসাঁর নিশানবর্দার সংগঠনেরও সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম দেশে দেশে। ক্রমবর্ধমান হারে তরুনদের সম্পৃক্ততায় এ সংগঠনগুলো বিকশিত হয়ে উঠছে। ত্যাগ ও কোরবানীর ক্ষেত্রেও রেনেসাঁ-কাফেলার নিশান বর্দাররা পিছিয়ে নেই। আজ গোটা দুনিয়ায় আদর্শের জন্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিচ্ছে একমাত্র মুসলমানরাই।

তবে প্রয়োজনের তুলনায় এবং চ্যালেঞ্জের নিরিখে এটুকু যথেষ্ট নয়। এসব কাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মৌল কিছু বিষয়ে মুসলিম তরুনদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌল এই বিষয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়.

১. নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও তার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন, কোরআন-হাদীস এবং মহানবীর জীবন সম্পর্কেতো অবশ্যই, ইসলামের আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হবে।

২. ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রতিটি মুসলিম তরুনকে তার চারপাশে যা আছে, যা ঘটছে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নিরীক্ষনী দৃষ্টি রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব বিষয়ই এ নিরীক্ষনের ক্ষেত্রে তাদের মনে রাখতে হবে, দৃষ্টি-মনোহারীতা নয় সত্যই আসল কথা। আজ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন প্রচারণা জোরে খুব সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় গ্রহন বা বর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিবোধ সামনে রেখে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহন করতে হবে।

৩. তীব্র সাংস্কৃতিক সংঘাতের এই যুগে মুসলিম তরুনদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক নীতিবোধ ও পরিচয়কে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর্ট-আর্কিটেকচার থেকে শুরুকরে জীবন চর্চার সকল ক্ষেত্রে ইসলামের চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে ইসলামের সাথে অন্য সংস্কৃতিগুলোর মৌল পার্থক্য সমূহ। এই পর্যালোচনার জ্ঞান তাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমর্থ্য করে তুলবে।

৪. মুসলমানদের বিজ্ঞানের যে পতাকা ৯শ বছর আগে অবনমিত হয়েছিলো এবং সাড়ে ৬শ বছর আগে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেই ৪ পতাকার গর্বিত শির আবার উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য মুসলিম তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।

৫. ইসলাম সকল যুগের সর্বাধুনিক মতবাদ। এ মতবাদকে যুগপূর্ব অচল ভাষা বা কৌশল নয়, যুগশ্রেষ্ঠ ভাষায় যুগোত্তর লক্ষ্য সামনে রেখে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু তাহলেই এই আদর্শ যুগ-চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সকল মানুষের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে।

এই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে মুসলিম তরুনরা যে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে সজ্জিত হবে তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মূলতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এই চ্যালেঞ্জর মধ্যে অবশ্যই অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরশক্তির মত দিকগুলো আছে। তবে এগুলোর অর্জন, অধিকার, ব্যবহার, কার্যকারিতা- সবকিছুই বুদ্ধির শক্তির উপর নির্ভরশীল। কম্যুনিজম রক্ষার সব অস্ত্র সব অর্থ সোভিয়েত ভান্ডারে থাকার পরও বৈরী জ্ঞান ও সংস্কৃতির সয়লাবে যেমন তা শেষ হয়ে গেছে, তেমনি, 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম' এবং আগ্রাসী পুঁজি ও আধিপত্য রক্ষার 'গণতন্ত্র' তার ভান্ডারে সব অস্ত্র, সব অর্থ রেখেই শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রয়োজন শুধু ইসলামের মহান মানবতাবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধুনিকতম মানের প্রচন্ড এক সয়লাব।

লেখক-
আবুল আসাদ
সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম 
বই- একুশ শতকের এজেন্ডা

মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামী দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়? -মাওলানা ইমাম হোসাইন


দ্বীন বিজয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা নিহত হয় ইসলামের পরিভাষাগত তাদেরকে শহীদ বলা হয়।

"শহীদ" এই পরিভাষাকে রাসুল (স) আরো ব্যাপকতা অর্থে ব্যবহার করেন। যেমন: জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলে, আগুনে পুড়ে নিহত হওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে,পানিতে ডুবে মারা যাওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুকেও শহীদি মৃত্যু বলে। শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা রেখে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করাকেও শহীদি মৃত্যু বলে।

কিন্তু সম্মুখ সমরে দ্বীনের জন্যে লড়াই করে শাহাদাত আর উল্লেখিত অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, আগুন এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের মর্যাদা এক নয়। বস্তুত এই দুই অবস্থার মৃত্যুকে তখনই শহীদি মৃত্যু বলা যাবে যদি মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হয়। অর্থাৎ শাহাদাতের সাথে ঈমান বা বিশ্বাসের ওতোপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।

পৃথিবীর সকল ন্যায় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তি কি শহীদ?

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের অধিকার, সাম্য সমতা, মানবিক মর্যাদা, দেশ জাতির জন্য ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য মানুষ অসংখ্য আন্দোলনে মারা গিয়েছে। এদের সবাইকে শরীয়াহর মানদন্ডে শহীদ বলা যাবেনা। শহীদ বলতে হলে ঐ ন্যায্য আন্দোলনের সাথে ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, দেশ ও জাতির দ্বীন এবং ঈমানের অপরিহার্যতার সম্পর্ক লাগবে। এইজন্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের শহীদ বলা গেলেও হিন্দু সম্প্রাদায়ের নিহতদেরকে ইসলামী শরিয়াহর মানদণ্ডে কি শহীদ বলা যাবে? শহীদ হতে হলে ইসলামের বিশ্বাসকে ধারণ করতে হবে। কারণ শহীদ মর্যাদাটি ইসলামী পরিভাষা। মোটকথা কাউকে শহীদ বলতে হলে তার ইমানের অপরিহার্য সম্পৃক্ততা লাগবেই।

বাংলাদেশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীদের শহীদ বলা হলেও কথিত মুলধারার জাতিয়তাবাদি, সেক্যুলার, সমাজতন্ত্রী কর্মীদেরকে কি শহীদ বলা যাবে?

[এই বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার পুর্বে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটগত এবং ব্যবহারগত শহীদ শব্দটির ২টি ধারা বিদ্যমান। যেমন: বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় মর্যাদাগত উপাধিতে দেশের আন্দোলনের যেকোন ব্যক্তিকে শহীদ বলা হয়। এক্ষেত্রে অনেক হিন্দু, নাস্তিক বামদেরকেও শহীদ উপাধি দিয়ে থাকে রাস্ট্র। যা ইসলামের মুলনীতির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কিন্তু এই বাস্তবতাকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সবাইকে মানতে হয়।

দ্বিতীয়ত, দ্বীন আর ইসলামী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিকে ইসলামী দলসমূহ শহীদ বলে থাকে।ফিকহী উসুলের দিক থেকে ইসলামে এটাকেই শাহাদাত বলা হয়ে থাকে যা সকল যুগেরই প্রারম্ভনা আজ পর্যন্ত। ]

উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর হলো স্বৈরাচার জুলুমকে প্রতিহত করতে সকল দলমতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নিহত সবাইকে শহীদ বলতে হলে তাদেরকে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি থেকে বলতে হবে। উদাহরণগত জাতিয়তাবাদি, সমাজতন্ত্রবাদি, সেকুলারদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ন্যায্য হলেও পরক্ষণে তাদের বিশ্বাস যে তারা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের মানব রচিত বিশ্বাসকে তারা প্রতিষ্ঠিত করবে। সুতরাং তাদের ন্যায্যত আন্দোলন সত্বেও বিশ্বাসের বিচ্যুতকারনে ইসলামী মুলনীতিতে শহীদ হবেনা। বিপরীতে ইসলামি দলগুলো স্বৈরাচার বিরোধী ন্যায্যত আন্দোলনে জুলুমের পতনের মধ্যদিয়ে ইসলামকেই প্রতিষ্ঠারই কর্মপ্রয়াস চালাবে। ফলশ্রুতি তাদের ন্যায্যত আন্দোলনে মাকাসাদ শরীয়াহ থাকার কারণে তাদের কোন কর্মী নিহত হলে শরীয়াহর মূলনীতিতে তাদেরকে শহীদ বলা যাবে।

মৌলিক জিজ্ঞাসা হলো স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামি দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়?

সাধারণত ইসলামি দলগুলো সামগ্রিক গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে না। মুলত গনতন্ত্র হলো আজকের বিশ্বের একটা নিয়মাতান্ত্রিক রাস্ট্রিয় পরিচালনা প্রক্রিয়া। যেখানে গনতন্ত্রের সকল মুলনীতির মাঝে কিছু আছে ইসলামের মূলনীতি সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে আর কিছু আছে যা ইসলামের চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা পরিবর্তনে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামস্টিক দিক ইসলামের সমর্থন যোগ্য।তাই ইসলামি দলগুলো রাস্ট্রিয় পর্যায়ে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠায় জনমত গঠনে গনতন্ত্রের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাহন হিসেবে দেখে। যা একালের সকল ইসলামী রাস্ট্রচিন্তাবিদ্বের সর্বসম্মত মত।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জনমত তৈরীর একটি বাহন হিসেবে গনতন্ত্রের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীকে শহীদ বলা যাবে। বাহনগত দিক থেকে তা গনতান্ত্রিক আন্দোলন হলেও মাকাসাদে শরিয়াহ তথা উদ্দ্যেশ্যগত দিক থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

[এছাড়াও বাংলাদেশের এখনকার আন্দোলন মুলত নিয়মাতান্ত্রিক জুলুম তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, দেশ জাতি এবং সামগ্রিক ইসলামকে অক্ষুন্ন রাখার আন্দোলন। শুধুমাত্র একটা গনতন্ত্র শব্দ দিয়ে এই ন্যায্য আন্দোলনকে হালাল হারাম ফতোয়ার প্যাঁচে ফেলানো নিতান্তই চাটুলতা। ]

সুতরাং সকল আন্দোলনে যে কাউকে শহীদ বলতে হলে তার বিশ্বাস এবং মাকাসাদ তথা উদ্দ্যেশ্যে হতে হবে ইসলাম এবং শরীয়াহ। আর সকল ইসলামী দল তাদের সকল আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডের মাকাসাদ থাকে মূলত হুকুমতে শরিয়াহ এবং ইকামাতে দ্বীন।

[বি: দ্র: শাহাদাতের কবুলিয়াত আল্লাহর দিকেই নিসবত। কাউকে আমাদের শহীদ বলা না বলার মধ্যে শহীদি মর্যাদা নির্ভর করে না। মূলত এটি আখেরাতের অর্জন। দুনিয়াতে আপনি যাকে শহীদ বলতেছেন পরকালে সে হয়তো আল্লাহর নিকট শহীদ না। আবার আমরা যাকে শহীদ মনে করতেছিনা হয়তো সে আল্লাহর নিকট শহীদ। এইজন্য মুমিন সবসময় তার ভাইয়ের শাহাদাতের দোয়া করবে।]


লিখেছেন:
খতীব, দক্ষিণ মন্দিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ
ছাগলনাইয়া, ফেনী।

শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২

ইসলামী রাজনীতিতে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ : মু. ইমাম হোসাইন

গনতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা পশ্চিমাদের আবিস্কৃত, তাই এটি জায়েজ না জায়েজ এবং হালাল-হারামের পক্ষ বিপক্ষ দলীল যুক্তি থাকতে পারে।
যেহেতু এই ব্যবস্থা নব্যআবিষ্কৃত, তাই উম্মাহর আলেমদের একটা অংশ গনতন্ত্রকে হারাম বললেও ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে শরিয়াহর মানদণ্ডে আধুনিক ইসলামী রাজনীতি তত্ত্বে প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থাকে ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে এটিকে জায়েজ পর্যায়ে ঘোষণা করে। 
এছাড়া দেশ এবং উম্মাহর কল্যানে ইসলামি রাজনীতিতে মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীদের ভোট প্রদানে ইসলামী দলগুলো উৎসাহ দিয়ে থাকে এইজন্যে যে, তারা ইসলাম বিরোধীদের তুলনায় ইসলামের পক্ষেরই শক্তি।
 
বর্তমান আলেমদের যে অংশ গনতান্ত্রিক পন্থায় গনতন্ত্রের সমস্ত কর্মসূচিকে যারা হারাম ঘোষণা দিচ্ছে তাদের ব্যাপারে আমাদের কথা হচ্ছে, আপনারা প্রচলিত ইসলামি রাজনীতির বিপরীতে উম্মাহর সামনে কোন বিকল্প উপস্থাপন করেছেন?
খেলাফত প্রতিষ্ঠায় প্রচলিত ইসলামি রাজনীতি সুন্নাহ পদ্ধতি না হলে তাহলে আপনারা সুন্নাহর পদ্বতি পেশ করুন।
আদৌ কি করেছে? না।
 
আমার জানামতে সুন্নাহ পদ্ধতির যে দুটি প্রক্রিয়া হতে পারে তা হলো:
✅প্রথমত: হয় আপনি প্রতিষ্ঠিত এই সরকার এবং দেশের প্রচলিত সংবিধানের বিপক্ষে গিয়ে নিজের ইসলামি খেলাফত ঘোষনা করুন এবং মুসলিম উম্মাহকে আপনার আনুগত্যের আহবান করুন। যেমনটা আগেকার ইসলামি খেলাফতে (আম) হয়ে আসছে। যেমনঃ আব্বাসীয় এবং উসমানিয়দের খেলাফত এভাবেই ঘোষণা হয়েছে।

✅দ্বিতীয়ত: রাসুল (স) মদিনার নওমুসলিমদের আকাবার বাইয়াতের শপথে আশ্বস্ত হয়ে মদিনায় আগমন করলে, মদিনাবাসী রাসুল(স.) কে সর্বজনীন গ্রহন করলে রাসুল (স.) ইসলাম রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এখন আপনি বাংলার মুসলিমদের নিকট থেকে সমর্থন নিয়ে ইসলামি রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করুন। আর এই আধুনিক এই জীবন ব্যবস্থায় সমস্ত জনগণ অথবা বোদ্ধা নাগরিকদের ইসলামী রাস্ট্র সম্পর্কে সমর্থন নিতে একটি সুন্দর বিকল্প প্রদান করুন। আর না হয় সরাসরি রাসুল(স.) এর পদ্ধতিতে গ্রহন করতে আপনি কোন আনুষ্ঠানিক এবং সামগ্রিক প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন।

✔খেলাফতে রাশেদার ক্ষমতা গ্রহনের কোন পদ্ধতি এইদেশে ফলো হবেনা। কারণ, খেলাফতে রাশেদা মূলত রাসুল(স.) এর রাষ্ট্রীয় স্থলাভিষিক্ততা বা খেলাফত।
খেলাফতে রাশেদার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হলে আগেই ইসলামি রাস্ট্র বা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে হবে কারন খেলাফতে রাশেদার পদ্ধতি ইসলামী রাস্ট্রের অভ্যন্তরে খলিফা নির্বাচন ছিলো। আর বাংলাদেশে প্রথমে ইসলামি রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা তারপর খেলাফত নির্বাচন।
উম্মাহর সামনে কোন কর্মসূচি না রেখে গড়বাধা নিজের সংকীর্ণ চিন্তা থেকে কোন একটা পদ্ধতিকে হারাম ঘোষণা হলো উম্মাহর সাথে গাদ্দারি বা উম্মাহর বিনাশ সাধন।

পশ্চিমাদের ইংরেজি হারাম ঘোষনা দেওয়া যেমন জাহালত ছিলো, তেমনি ক্ষমতা পরিবর্তনে ইসলামি রাজনীতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকেও হারাম ঘোষনা হলো জাহালত ছাড়া কিছুনা। 
দ্বীন বিজয়ে দাওয়াহ’র কাজে আল্লাহ প্রদত্ত আয়াতে যে ‘হিকমত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন তারই আলোকে শরিয়ত হারাম করেনা এমন যেকোন বিষয় উম্মাহর বৃহত্তর কল্যানে ব্যবহার করা শুধু জায়েজই নয় বরং উত্তম পদ্ধতি হতে পারে। [তবে পুরো গনতন্ত্র মতবাদের সাথে কোন ইসলামী দলই একমত নয়]

একটা অংশ তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহনকে এর ফরমুলা হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়, আমার মনে হয় তারা তালেবানদের সম্পর্কে জানেই না।
মুলত ৯৫তে তালেবানরা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীতে আমেরিকার হস্থক্ষেপে তাদের পতন হলে তারা সশস্ত্র জিহাদে লিপ্ত হয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির নেতৃত্বে। এবং বিশবছর পর তারা তাদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পায়।
তাহলে আগেতো জনগনের সমর্থনে ক্ষমতায় আসতে হবে তারপরইতো ইসলামী রাস্ট্র রক্ষায় যাবতীয় প্রস্তুতি এবং সশস্ত্র জিহাদ। যেখানে নিজেদের রাস্ট্র নাই অবস্থা নাই দলাদলি-মারামারি আর সেখানে উনি আসছে কুফর ফতুয়া দিতে।

এরা উম্মাহর বড় গাদ্দার, এরা উম্মাহকে আবহমানকালের ধারাবাহিকতায় কিছু দিতে পারেনাই পারবেওনা। শুধু বড় কিতাবের জ্ঞান থাকলেই যে ফতুয়া দেওয়া যায় তেমন না তাকে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট অবস্থা বাস্তবতা থেকেই আইন দিতে হবে।
....যেখানে পৃথিবী বিখ্যাত আলেম ড. ইউসুফ আল কারজাবী, তাক্বী উসমানিরা জায়েজ বলেছে আর উনি এখানে খানকাহর ফাঁকা আওয়াজে শুধু ফতুয়া বিলাচ্ছে।


লেখক:
মু. ইমাম হোসাইন
ইসলামী চিন্তাবিদ ও সংগঠক
(https://www.facebook.com/profile.php?id=100012718592294 )

রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১

শহীদ আব্দুল মালেক : প্রেরণায় ভাস্বর এক কিংবদন্তী



হীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও বীর সেনানী।শহীদ আব্দুল মালেক একটি নাম,একটি প্রেরণা, একটি বিশ্বাস, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস, একটি মাইলস্টোন।পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে ১৯৬৯ সালে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে কথা বলতে গিয়েই ঢাকায়  ইসলাম বিদ্বেষী সেকুলার পন্থীদের হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ১৫ আগস্ট শাহাদাৎ বরণ করেন ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের তাৎপর্য ছাত্র সমাজের কাছে তুলে ধরা এবং তাঁর আত্মত্যাগ থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার নিমিত্তে ইসলামী ছাত্রশিবির এ দিনটিকে ‘ইসলামী শিক্ষা দিবস’ হিসেবে প্রতিবছর পালন করা আসছে।

শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ও ঘটনা:

১৯৬৯ সালে পাকিস্তান ঝুড়ে ব্যাপক গন-অভ্যুত্থান দেখা দেয়।ফলে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করেন।এরই এক পর্যায়ে এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন রিপোট প্রকাশিত হয়।এই রিপোট প্রকাশিত হবার পর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়।ছাত্র সমাজের একটি অংশ ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের দাবী তুলে।শহীদ আব্দুল মালেকসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এয়ার মার্শাল নূর খানের সাথে সাক্ষাৎ করে দেশে সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। শহীদ আব্দুল মালেকের প্রতিনিধি দলের পর দেশের অন্যান্য আরও সংগঠন একই দাবি তুলেন।সবার দাবির মুখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।এটি ছিল পাকিস্তান আমলের গঠিত সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন।গঠিত শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষা নীতিও ঘোষণা করেন, ঘোষিত শিক্ষানীতিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।কিন্তু বাধসাদে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা।তারা এ শিক্ষা নীতি বাতিলের দাবি জানায়।এমনই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কি হবে তা নিয়ে জনমত জরিপের আয়োজন করা হয়।জনমত জরিপের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২ আগস্ট “National Institute of Public Administration” (NIPA) এর উদ্যোগে সরকারের পক্ষ থেকে ‘‘শিক্ষার আদর্শিক ভিত্তি’’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে।।ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন আব্দুল মালেক সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৫ মিনিটের বক্তব্যে বামপন্থী সকল ছাত্র সংগঠনের সকল যুক্তিকে হার মানিয়ে উপস্থিত সবার চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে জনমত সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। ফলে সভার মোটিভ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ইসলামী শিক্ষার পক্ষে মতামত প্রকাশ করায় সেকুলার মহল মরিয়া হয়ে উঠে।ছাত্রদের এ মতামতকে বানচাল করার জন্য পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে ডাকসু কর্তৃক ১২ আগস্ট আরো একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।এর মূল আয়োজক ছিল বামপন্থী শিক্ষকরা।তারা সেখানে আব্দুল মালেককে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।আব্দুল মালেক তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে টিএসসির আলোচনা সভা স্থলেই তার প্রতিবাদ করেন।এই প্রতিবাদ সংঘর্ষে রুপ লাভ করে। সংঘর্ষ এক পর্যায়ে থেমে যায়।কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আব্দুল মালেক ও তার কতিপয় সঙ্গীকে টিএসসির মোড়ে সেকুলারপন্থীরা হামলা করে এবং রেসকোর্সে এনে তার মাথার নীচে ইট দিয়ে উপরে ইট ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করে মারাত্মকভাবে জখম করে এবং অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে চলে যায়।ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে এ পরিকল্পিত হামলার নেতৃত্ব দান করে।আব্দুল মালেক ভাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।কিন্তু তার আঘাত এতটাই মারাত্মক ছিল যে,১৫ আগষ্ট তিনি শাহাদাৎ বরন করেন।

ইসলামী শিক্ষার পক্ষে শহীদ আব্দুল মালেকের অবস্থানের যৌক্তিকতা:

শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে একটি দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলোকিত করার প্রধান সোপান,জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি,জাতীয় ঐক্যের প্রতীক,জনগনের মধ্যে চিন্তা ও কর্মের বিভাজন দূরীকরণের সহায়ক শক্তি এবং জাতীয় মিশন ও ভিশন বাস্তবায়নের রুপকার।জনগনের সকল প্রকার আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দীপক ও প্রেরণাদানকারী শক্তি হিসেবেও কাজ করে শিক্ষা ব্যবস্থা।শুধু তাই নয় জনগনকে তার সর্বোচ্চ ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত করণে শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিসীম ভূমিকা থাকে।জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে শিক্ষা ব্যবস্থা অদম্য প্রত্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে জনগনের মধ্যে শক্তি যোগায়।মূলতঃ শিক্ষা ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে একটি দেশের গোটা জাতীয় সত্তার কাঠামো।কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত না হওয়ায়  আমাদের জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট আদর্শিক শূর্ন্যতা,নৈতিক দুর্বলতা,ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিভাজন,আগামী প্রজন্মের মধ্যে হতাশা,জাতীয় উন্নতিতে স্থবিরতা,জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অশান্তি,বিশৃংখলা ও অস্থিরতা ইত্যাদি ইত্যাদি।এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং ভবিষ্যতে এর সুদূর প্রসারী  আরো নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে সেদিন শহীদ আব্দুল মালেক  ইসলামী শিক্ষার পক্ষে তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

ইসলামী শিক্ষার সুদুরপ্রসারী প্রভাব:

শিক্ষাকে বলা হয় একটি জাতির মেরুদন্ড।যা জাতিকে খাড়া রাখে কিংবা পড়ন্ত অবস্থা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করায়।এটা তখনই সম্ভব হয় যখন ঐ জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতি অনুযায়ী।মিশরীয় দার্শনিক Professor Muhammad kutub তাঁর “ The Concept of Islamic Education” প্রবন্ধে বলেছেন,“শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের কাজ হলো পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করা,গড়ে তোলা এমন একটি কর্মসূচী যা মানুষের দেহ,তার বুদ্ধিবৃত্তি এবং আত্মা,তার বস্তুগত ও আত্মিক জীবন এবং পার্থিব জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের একটিকেও পরিত্যাগ করেনা,আর কোন একটির প্রতি অবহেলাও প্রদর্শন করেনা”।

ইসলামী শিক্ষার ভিত্তি হল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত।যা সর্বস্তরে উচ্চ নৈতিকতা সম্পন্ন, নির্লোভ, সৎ,যোগ্য ও দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরী করে।মানুষের হাত-পা, মনন ও মস্তিষ্ক সবকিছুকে আল্লাহর অনুগত বানিয়ে থাকে।মানুষের ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত করে।ফলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শয়তানের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধ চলে।কেননা শয়তান সর্বদা পৃথিবীতে বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়।এমতাবস্থায় ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি শয়তানের যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সর্বদা পৃথিবীকে সুন্দরভাবে আবাদ করতে চায়।ফলে পৃথিবীর জীবন পদ্ধতি অনেক সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়।

অপরদিকে শিক্ষা ব্যবস্থা যদি এর বিপরীত হয়, তাহলে ঘুণে ধরা বাঁশের মত জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে।আজকের পৃথিবীতে বড় বড় অশান্তির মূল কারণ হল শিক্ষিত নেতৃবৃন্দ।যাদের শিক্ষায় আল্লাহভীরুতা নেই, আখেরাতে জবাবদিহিতা নেই।স্রেফ রয়েছে দুনিয়া সর্বস্বতা।ফলে শিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যে মানবীয়গুনাবলীর বিপরীতে দানবীয় গুনাবলী সৃষ্টি হচ্ছে।তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার কোন ঘাটতি না থাকলেও,সততা ও নৈতিকতার দিক থেকে তাদের অবস্থান অনেকটাই শুন্যের কোটায়।এই শ্রেনীর মানুষগুলোই দুনিয়াতে ভদ্রবেশে সকল প্রকার শয়তানী অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।একটি দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরোহন করতে  কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক একক ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর বিকল্প নেই।আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের কোন সরকারের জন্য তা অপরিহার্যও বটে।

শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের প্রভাব:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সম্ভবতঃ আব্দুল মালেক ভাইয়ের মত মেধাবী ছাত্র নেতার শাহাদাৎ এর আগে ঘটেনি।ফলে আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতে গোটা দেশ স্তব্দ হয়ে যায়।সর্বমহলে এই ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের বিদায়ে কেঁদেছে গোটা জাতি। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সে সময়ের সংবাদ পত্র তার সাক্ষী।আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সভাপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্রনেতা আব্দুল মালেকের শাহাদাতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। এছাড়াও সকল জাতীয় নেতারা নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিল।এ থেকেই বুঝা যায়,শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাৎ কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

শহীদ আব্দুল মালেকের জানাযা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে।আওলাদে রাসূল (সা)সাইয়েদ মোস্তফা আল মাদানী জানাযার ইমামতি করেন।জানাজার পূর্বে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন- “শহীদ আব্দুল মালেকের পরিবর্তে আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ করতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম।বিশ্ববরেন্য ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ)তার শোক বানীতে মন্তব্য করেন, “এক মালেকের রক্ত থেকে লক্ষ মালেক জন্ম নিবে”।তার এ মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল।

সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, “আব্দুল মালেকের মতো একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শহীদ হবার ফলে গোটা আন্দোলনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে,নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি না হলে এতটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতোনা।আব্দুল মালেকের শাহাদাত আর পরবর্তী শাহাদাতের তুলনা করলে এটাই দেখি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাতের ফলে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া পরবর্তীদের ক্ষেত্রে হয়নি। আন্দোলন যখন শক্তি সঞ্চয় করেছে মাত্র তখন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাত আন্দোলনের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল” ।তিনি আরো লিখেছেন, “আব্দুল মালেক জীবিত থেকে এই আন্দোলনের জন্য যে অবদান রাখতে পারতেন শহীদ হয়ে যেন তার চাইতে বেশী অবদান রেখে গেলেন।তা্র এ শাহাদাতের প্রেরণায় আন্দোলন যতদূর অগ্রসর হয়েছে,যত লোকের মধ্যে শাহাদাতের জযবা সৃষ্টি হয়েছে তার মতো যোগ্য কর্মী বেঁচে থাকলেও তিনি যতো যোগ্যই হোন না কেন তার একার জীবনে এতো বড় প্রভাব এবং আন্দোলনে এতটা গতি দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ”।শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের সংবাদ শুনে সেদিন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.)বলেছিলেন-‘‘আব্দুল মালেক এদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তবে শেষ নয়।’’

আব্দুল মালেক ভাইকে শহীদ করার মাধ্যমে সেদিন সেকুলার পন্থীরা ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের পক্ষে আওয়াজ তোলাকে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের সে পরিকল্পনা সাময়িক বাস্তবায়িত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী তাদের জন্য বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।যে কোন আন্দোলনের কোন ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য কোন ব্যক্তি যখন শহীদ হন তখন সে আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়া সম্ভব হয়না বরং উল্টো সে আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে যারা ভীরু এবং কাপুরুষ তারা পিছিয়ে যায়।আর যারা এ আন্দোলনকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে এবং ইসলামী আন্দোলনের স্পিরিটকে যারা বুঝে আগের চাইতে তারা আরো দ্রুত এগিয়ে যায়।তাছাড়া এ অবস্থায় আন্দোলনে নতুন নতুন লোকও এগিয়ে আসে।বাস্তবে এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।এক আব্দুল মালেককে শহীদ করে শত্রুরা শত শত আব্দুল মালেক সাপ্লাই করেছে আন্দোলনে।এক আব্দুল মালেকের শাহাদাতের ফলে আন্দোলন শত শত আব্দুল মালেককে পেয়েছে যারা তার মতো মনে-প্রানে শাহাদাৎ কামনা করে।এটা যে কোন আন্দোলনের জন্য সত্য আর ইসলামী আন্দোলনের জন্য বেশী সত্য।শহীদ আব্দুল মালেককে হত্যা করে ইসলামী আদর্শকে স্তব্ধ করা যায়নি।বরং এক মালেকের রক্ত বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে ছড়িয়ে একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।লক্ষ-কোটি মালেক আজ একই আদর্শের ছায়াতলে সমবেত।সুতরাং শহীদ আব্দুল মালেকের খুনীরা আজ অভিশপ্ত, ঘৃণিত এবং পরাজিত।জাতি তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রেরণায় ভাস্বর এক কিংবদন্তী শহীদ আব্দুল মালেক:

একজন মানুষ এ ভূবনে স্ব-মহিমায়, জ্ঞানে, ধ্যানে, চিন্তা-চেতনায় কত উজ্জ্বল ভাস্বর হতে পারে শহীদ আব্দুল মালেক তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে অনাগত পৃথিবীর কাছে।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবন, ছাত্রজীবন,সাংগঠনিক জীবন,তাঁর লেখনি, চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান,  দায়িত্বশীলদের সাথে মেলামেশা, সহপাঠি ও বন্ধুদের প্রকাশিত লেখায় মাধ্যমে যতটুকু জানার সুযোগ হয়েছে তাতে একথা নিদ্ধিধায় বলা যায়, শহীদ আব্দুল মালেক হচ্ছেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য প্রেরনায় ভাস্বর এক কিংবদন্তী, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এক অনুপম আদর্শ।তাইতো শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম লিখেছেন- “শহীদ আব্দুল মালেক তরুণ বয়সেই এমন এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন যা এদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা যোগাবে। এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মধ্যে এক সাথে থাকা অত্যন্ত বিরল।একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্র মহলে তার সুখ্যাতি সত্ত্বেও তার নিকট ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলনের জীবনই বেশী প্রিয় ছিল।যথাসম্ভব নিয়মিত ক্লাসে হাজির হওয়াই যেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল। পরীক্ষায় ভাল করার জন্য তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ছিলনা।ওটা যেন অতি সহজ ব্যাপার ছিল।ক্লাসের বাইরে তাঁকে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাধারা বা আলাপ-আলোচনা করতে বড় একটা দেখা যেত না।তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা তাকে পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে মৃদু হেসে বলতেন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয়-রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাই না।খুব ভাল রেজাল্টের ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবার নেশায় পেয়ে বসবার আশঙ্কা আছে।

ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান প্রজন্মের কর্মীদের অনুপ্রেরনার জন্য শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের জীবনের কিছু খন্ড চিত্র নিম্নে উপস্থাপন করা হল।

১.অদম্য মেধা:

বাড়ীর পাশের খোকসা বাড়ির প্রাইমারি স্কুল থেকে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়।আব্দুল জলিল সাহেব ছিলেন খোকশাবাড়ী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক।তিনি স্কুলে ভর্তি হবার সময় শিশু আব্দুল মালেককে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন।সবকটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে তিনি এতই অভিভূত হলেন যে আব্দুল মালেককে তিনি সরাসরি ২য় শ্রেনীতে ভর্তি করে নিলেন।বাড়ী থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গোসাইবাড়ী হাই স্কুল।এলাকার মধ্যে এ স্কুলটির বেশ সুনাম থাকায় শিশু আব্দুল মালেক সে স্কুলে পড়ার আগ্রহ পোষণ করেন।অতঃপর ৪র্থ শ্রেনীতে তাকে সে স্কুলে ভর্তি করা হল।১৯৬০ সালে আব্দুল মালেক জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন।আব্দুল মালেক চাচ্ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে।কিন্তু গোসাইবাড়ী হাই স্কুলে তখনও বিজ্ঞান বিভাগ ছিলনা।আব্দুল মালেকের প্রত্যাশা অনুযায়ী তাকে বগুড়া জেলা স্কুলে নবম শ্রেনীতে ভর্তি করা হল।সেখান থেকে এসএসসি তে বিজ্ঞান বিভাগে মেধাতালিকায় ত্রয়োদশ স্থান অর্জন করেন।এ সময়ে তার পিতা ইন্তেকাল করেন।এরপর তিনি ভর্তি হন রাজশাহী সরকারী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে।সেখানেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে মেধাতালিকায় ৪র্থ স্থান অধিকারের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন এবং ডিপার্টমেণ্টের মেধাবী ছাত্র হিসেবে ১ম স্থান অধিকার করেন।স্কুল জীবন থেকে শহীদ আব্দুল মালেক মৌলভী মহিউদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর খুব দ্রুত সংগঠনে এগিয়ে এসে সর্বোচ্চ মান সদস্যে উন্নীত হন। একপর্যায়ে ঢাকা মহানগরী এবং নিখিল পাকিস্তান ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মজলিস-উশ-শূরার সদস্য নির্বাচিত হন।

২.সাদাসিধে জীবন যাপন

শহীদ আব্দুল মালেক অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন।পোশাক বলতে ছিল একটি কমদামী সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবী যাতে ইস্ত্রির দাগ কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা যায়না ।রাতের বেলায় নিজ হাতে তিনি তা পরিস্কার করতেন।যেন পরের দিনের সূচনায় তা আবার পরা যায়।অনেকের মত নূর মুহাম্মদ মল্লিকও লিখেছেন,  “সারাদিন কাজ করে রাতের বেলায় তাঁর নিজের হাতে ক্লান্ত শরীরে সেই একমাত্র পাজামা পাঞ্জাবী ধোয়া রুটিন কাজের কথা।কোন এক রাতে সেটি ধোয়া সম্ভব হয়নি বলে সকালে ধোয়া পাঞ্জাবী আধা ভেজা অবস্থায় গায়ে জড়িয়ে মালেক ভাই গিয়েছিলেন মজলিসে শূরার বৈঠকে যোগ দিতে।মালেক ভাইয়ের পোশাক যেমন সাধাসিধে ছিল, দিলটাও তেমন সাধাসিধে শুভ্র মুক্তার মত ছিল।প্রাণখোলা ব্যবহার তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে তাঁর এক হলমেট লিখেছেন-শহীদ আব্দুল মালেকের পোশাকাদি ও স্যান্ডেল দেখে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কেউ তাঁকে Underestimate করতে পারতো।কিন্তু তার সাথে কথা বলার স্কোপ হলে ৫ মিনিটের মধ্যে এই ভুল বিশ্বাস অবশ্যই ভেঙ্গে যেতে বাধ্য হত।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের সহকর্মী আবু শহীদ মোহাম্মদ রুহুল সাক্ষাৎকারে আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে বলেছেন- “একদা আমরা একসাথে চকবাজারে কালেকশানে যাই।তখন তাঁর অতি সাধারণ ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবী-পায়জামা এবং চপ্পল দেখে এক সুধী মালেক ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয় বলে মনে করেন।এতে সহকর্মীরা ক্ষুদ্ধ হলে মালেক ভাই আমাদেরকে এ বলে সান্ত্বনা দেন যে,আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিনা তা আল্লাহই ভাল জানেন।আমি আমার জন্য যে মানের পোশাক প্রয়োজন মনে করেছি সে মানের পোশাকই পরিধান করেছি।কে আমার পোশাক দেখে কি ভাবল তাতে আমার কোন ভাবনা নেই”।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের সাথে মারাত্মক আহত হওয়া মাওলানা মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে বলেন-মালেক ভাই খুব সাদাসিধে থাকতেন।অনেক সময় পাজামা-পাঞ্জাবীর সাথে ইংলিশ সু পরতেন।আমরা বলতাম ,মালেক ভাই এটাতো মিলল না।উনি বলতেন।এত কিছু দেখার সময় আছে নাকি?মালেক ভাই প্রায়ই বলতেন,পড়াশুনা করে শুধু বড় ডিগ্রী নিয়ে কি লাভ যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা না পাওয়া যায়।ডিগ্রি তো নেয়া শুধু বাঁচার তাকিদে।

৩.সংগ্রামী জীবন:

ইসলামী নেতৃত্ব সংগ্রাম,সংঘাত ও কঠিন অগ্নী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়।শহীদ আব্দুল মালেক তাঁর সংগ্রামী জীবনের পদে পদে সেই পরীক্ষাই দিয়ে গেছেন।সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন।আর্থিকভাবে খুবই অসচ্ছল একটি পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল।তাই জীবন যাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকেও তিনি ছিলেন বঞ্চিত। সেই কচি বয়সে যখন তাঁর মায়ের কোলে থাকার কথা,তিনি থেকেছেন বাড়ী থেকে অনেক দূরে লজিং বাড়িতে।দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছে তাকে।ক্ষুধার যন্ত্রনা,অমানুষিক পরিশ্রম কিংবা দুঃখ-কষ্টের দিনযাপন কোন কিছুই পিচ্ছিল করতে পারেনি তাঁর চলার পথ।সামান্য বৃত্তির টাকা সম্বল করে নিজের জীবন এবং বিধবা মায়ের সংসার চালাতে হতো তাকে ।জনাব নূর মোহাম্মদ মল্লিক এক সময়ে কোন এক কারনে বেশ কিছু দিনের জন্য মালেক ভাইয়ের মেহমান হয়ে ছিলেন।তাকে মেহমানদারী করতে গিয়ে নীরবে নিভৃতে শহীদ আব্দুল মালেক কিভাবে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটিয়েছেন তার চোখ ভেজানো বর্ননা দিয়েছেন তিনি তার ‘চিরভাস্বর একটি নাম’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে : “স্কলারশীপের টাকায় তাঁর সবকিছু চলতো।কিছু টাকা মায়ের কাছেও পাঠাতেন।বাকী টাকা খাওয়া পরা ও আন্দোলনের জন্য খরচ করতেন।বেশ কয়েকদিন থাকার পর আমি লক্ষ্য করলাম মালেক ভাই ডাইনিং হলে খাচ্ছেন না।মনে করলাম মজলিশে শুরার বৈঠকের জন্য হয়তো তাঁদের সকলে একসঙ্গে খান সময় বাঁচানোর জন্য।শুরার বৈঠক শেষ হলো।এরপরও তাকে দেখিনা।এরপর একদিন দেখলাম তিনি রুটি আনাচ্ছেন।কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন,শরীর খারাপ।আমার সন্দেহ হলো,আমার জন্যই বোধ হয় তাকে কষ্ট করতে হচ্ছে।সামান্য ক’টি টাকাতে হয়তো তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না এবং এজন্য বিশেষ করে আমার ভার বহনের জন্যই তাকে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে বুঝতে পেরে তাঁর কাছ থেকে অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম”।

৪.জ্ঞানপিপাসু:

শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন অসম্ভব জ্ঞানপিপাসু।জানতে হলে পড়তে হয়। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই।শহীদ আব্দুল মালেক এ বিষয়ে আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। আন্দোলনী কর্মকাণ্ডের শত ব্যস্ততা মালেক ভাইয়ের জ্ঞানার্জনের পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও তিনি নাশতার পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতেন, সংগঠনের এয়ানত দিতেন।অথচ তাঁর রেখে যাওয়া এই দেশের ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা-কর্মীই এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে অনেকটা পিছিয়ে আছেন।

শ্রদ্ধেয় কৃতী শিক্ষাবিদ ড. কাজী দীন মুহাম্মদ-এর স্মৃতিচারণ থেকে আমরা জানতে পারি, শত ব্যস্ততার মাঝেও জ্ঞানপিপাসু আব্দুল মালেক দীন মুহাম্মদ স্যারের কাছে মাঝে মধ্যেই ছুটে যেতেন জ্ঞানের অন্বেষায়।তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ইসলামী আন্দোলন করতে হলে কুরআন-হাদীস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং-বীমা, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় জানতে হয় কিংবা জ্ঞান থাকতে হয়।

মরহুম আব্বাস আলী খান এ প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে বলেন : “বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর পাকা হাতের লেখা পড়তাম মাসিক পৃথিবীতে। বয়স তখন তাঁর উনিশ-বিশ বছর। একেবারে নওজোয়ান। কিন্তু তার লেখার ভাষা ও ভঙ্গী বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর তীক্ষ ও গভীর জ্ঞান তাঁর প্রতি এক আকর্ষণ সৃষ্টি করে।”

শহীদ মোহাম্মদ কামারুজ্জমান আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে লিখেছেন –“রাতে ঘুমানোর আগে দেখতাম মালেক ভাই ইংরেজি একটি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছেন।আবার কিছু কিছু নোট করছেন।তিনি মাসিক পৃথিবীতে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির উপর লিখতেন। বুঝলাম সেই লেখার জন্য মালেক ভাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।তখন থেকেই বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ার ব্যাপারে আমার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। মালেক ভাইয়ের অনেক স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়”।

শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের হলমেট ড: এ জামান আব্দুল মালেক ভাইকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ মূলক লেখায় লিখেছেনঃশহীদ আব্দুল মালেকের বৃত্তির একটা বড় অংশ ব্যয় হত বই কেনার পেছনে।ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইসলামী আন্দোলন সংক্রান্ত বহুবিধ পুস্তক তাঁ ব্যক্তিগত পাঠাগারে সংগৃহীত ছিল।

৫.আন্দোলনের কর্মীদের সাথে আচরণ:

শহীদ আব্দুল মালেক প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর কর্মীদের। সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ নিঃস্বার্থ।তাঁর জীবনালেখ্য রচয়িতা ইবনে মাসুম লিখেছেন :“কর্মীদের তিনি ভালোবাসতেন।তিনি ছিলেন তাদের দুঃখ-বেদনার সাথী।তাঁর এই আন্তরিকতার জন্য অনেক কর্মীর কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মত।কর্মীদের সাথে দেখা হলেই কুশল আলাপ করতেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তাঁর রুম ছিল কর্মীদের জন্য তীর্থস্থান।কর্মীদের সাথে আন্তরিকতার সাথে মিশে জেনে নিতেন তার দুঃখ-বেদনা,তার দুর্বলতা,যোগ্যতা সবকিছু।দুঃখে জানাতেন সহানুভূতি।দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করে উপদেশ দিতেন তা শুধরে নিতে।সাধারণ কর্মীদের অত্যন্ত কাছাকাছি ছিল তাঁর অবস্থান।সকলের সমস্যা শুনতেন অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে,অনুভব করতেন নিজের মত করে এবং সমাধান দিতেন একান্ত আপনজন হিসেবে।কর্মীর যোগ্যতাকে সামনে রেখে উপদেশ দিতেন, অনুপ্রেরণা যোগাতেন প্রতিভা বিকাশে।ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিটি কর্মী সম্পর্কে তিনি নোট রাখতেন।প্রতিটি কর্মীর ব্যাপারে নিজের ধারণা লেখা থাকতো তাঁর ডাইরিতে। এমনিভাবে ভাবতেন তিনি কর্মীদের নিয়ে।ফলে কর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মালেক ভাই, একজন অভিভাবক, একজন নেতা।”

৬.আন্দোলনের প্রতি কমিটমেণ্ট:

শহীদ আব্দুল মালেক বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বের অধিকারী হলেও আন্দোলনের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট ছিল প্রবল।তাঁর এই কমিটমেন্ট শুধু যে সদস্য হওয়ার শপথ বাক্যে উচ্চারিত হয়েছে তা নয়,সাবেক লজিং মাস্টার জনাব মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে লেখা চিঠির ভাষাও তাঁর সেই কমিটমেন্টের প্রতিধবনি-‘‘জানি আমার দুঃসংবাদ পেলে মা কাঁদবেন, কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকেরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিল উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো নচেৎ সে প্রচেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণভরে দোয়া করুন জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের অন্ধকার, সরকারি যাতাকলের নিষ্পেষণ যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।”

৭.দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা:

দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল শহীদ আব্দুল মালেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। এব্যাপারে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শহীদ আব্দুল মালেক ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক লেখা ‘আমার প্রিয় সাথী’ তে লিখেছেন -‘‘সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল। আগামসি লেনস্থ সংঘের পূর্ব পাক দফতর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না আমাদের।বস্তির লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলাভবন, হোসেনী দালান ও সিটি ল’কলেজে আশ্রয় নিয়েছে।আমি কোনোমতে ফজলুল হক হলে গেলাম।ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা কি করতে পারি সে সম্পর্কে পরামর্শ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।এ প্রসঙ্গে কথা উঠার আগেই আব্দুল মালেকের মুখে খবর পেলাম ঢাকা শহর অফিসে পানি উঠেছে।বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই তিনি অফিসে গিয়ে সব দেখে এসেছেন।অধিক পানি ওঠায় কাগজপত্রাদি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।আব্দুল মালেক ওগুলো সব ঠিকঠাক করে এসেছেন।তাঁর দায়িত্ব সচেতনতার এ চাক্ষুষ প্রমাণটুকু আমার পক্ষে কোনোদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর কর্মী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন নিউমার্কেট ও আরেক দিন জিন্নাহ এভিনিউয়ে রোড কালেকশন করা হলো।অল্প সময়ে কর্মীদেরকে জমায়েত করে এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো আর কোন কর্মীই ছিল না।আমারতো কাজ ছিল শুধু কাগজের টুকরায় কিছু নোট লিখে অথবা আধঘণ্টা পনের মিনিটের আলাপে মোটামুটি কিছু বুঝিয়ে দেয়া।আব্দুল মালেকের সুদক্ষ  পরিচালনায় সংগৃহিত অর্থের নিখুঁত হিসাব পেলাম।সিকি, আধুলি, পাই পয়সা থেকে নিয়ে কত টাকার নোট কতটি, তার হিসেবের ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন।এরপর তিন দিন তিন রাত একটানা পরিশ্রম করে আব্দুল মালেক অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে চাল বন্টনের কাজ সমাধান করে ফেললেন। সেদিন আব্দুল মালেককে স্বচক্ষে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি।আর  আমি মুরুব্বি সেজে পরামর্শ দিয়েছি কাজটা আর একটু সহজে কিভাবে করা যায়।এই ভাগ্যবান ব্যক্তির পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য সেদিন তার সাথে মিলে নিজ হাতে কিছু করতে পারলে আজ মনকে কিছু শান্ত্বনা দিতে পারতাম।’’

৮.দায়িত্বশীলতা ও দায়িত্বসচেতনতা:

সাধারণত একজন নেতার যে সকল গুণাবলী থাকা দরকার শহীদ আব্দুল মালেকের মধ্যে তার পুরোটাই ছিল।১৯৬৮-৬৯ এর সেশন শুরু হয়েছে। আব্দুল মালেক ঢাকা শহর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।কেন্দ্রীয় কার্যকরি পরিষদের নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিতে নির্বাচিত তিনজন সদস্যের মধ্যে তিনি অন্যতম।ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপোষহীন, নির্ভীক।তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইসলামী আন্দোলনের কাজ অনেকটা গতিশীল হলো।তিনি ছিলেন কর্মীদের একজন আস্থাবান দায়িত্বশীল।এত বড় একজন দায়িত্বশীল হয়েও তিনি কর্মীদের খোঁজ-খবর নিতে ভুলতেন না।

একটি শিক্ষা শিবির পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।এক সময় জরুরী প্রয়োজনে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।হঠাৎ তাকে দেখা গেল শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহৃত ল্যাট্রিনের পাশে।তবে ল্যাট্রিন ব্যবহারের জন্য নয়।এক বুক পানিতে নেমে তিনি ল্যাট্রিন মেরামতের কাজে মগ্ন।এ অবস্থা দেখে তো চোখ ছানাবড়া।অথচ এ কাজটি তিনি অন্যকে দিয়েও করাতে পারতেন।কতটুকু দায়িত্ব সচেতনতা তাঁর মধ্যে ছিল এ থেকে তা অনুমান করা যায়।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের একটা চিরাচরিত অভ্যাস ছিল চিঠির মাধ্যমে কর্মীদের প্রেরণা যোগানো।তিনি নিয়মিতই বিভিন্ন কর্মীকে চিঠি লিখতেন।এমনি একজন কর্মী বেলালকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন-‘‘সৃষ্টির আদি থেকে একটি শ্বাশ্বত নিয়মের মতো এ সত্য চলে এসেছে যে, মহাপুরুষরা সত্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের মন-প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন।নির্মম সমাজ সেই মহাপুরুষকেই কঠিন ও নির্দয়ভাবে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে।বিদ্রুপ, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার এই ইতিহাস নতুন কিছু নয়।আরবের বালুকণা ও প্রস্তর কাদের তাজা খুনে রঞ্জিত হয়েছিল? ওমর, ওসমান, আলী আর হাসান হোসাইন এর জীবন নাশের জন্য কারা দায়ী? ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ, মুহাম্মদ ইবনে কাশিম, কোতায়বা কাদের চক্রান্তে নিহত হয়েছিলেন? ইসলামের ইতিহাস পড়ে দেখ, রক্তের লাল স্রোত শুধু কারবালাতেই শেষ হয়ে যায়নি।আজও পৃথিবীর বুকে সহস্র কারবালা সৃষ্টি হচ্ছে।আজো মুসলমান ফাঁসির মঞ্চে নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে খোদার দ্বীনকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তোমরাতো পৃথিবী দেখনি, দেখনি মুসলমানদের উপর নির্যাতন, শোননি তাদের হাহাকার।যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানব নিজের জীবন তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন, যার জন্য হাজারো মুজাহিদের তপ্ত রক্ত পৃথিবীর মাটি লাল করে দিয়েছে, সেই ইসলামই লাঞ্ছিত হচ্ছে মুসলমানদের হাতে।”

৯.স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা:

ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের জন্য সংগঠন পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।শহীদ আব্দুল মালেক ভাই ছিলেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অগ্রপথিক।তৎকালীন সময়ে ঢাকা মহানগরীর সভাপতি অধ্যাপক ফজলুর রহমান মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “আমি যখন ঢাকা মহানগরীর সভাপতি,মালের ভাই তখন ছিলেন শাখা সেক্রেটারী।একদিন রাতের বেলায় অফিসে গিয়ে দেখলাম মালেক ভাই মোম জ্বালিয়ে খাতা কলম নিয়ে হিসেব করছেন।আমি ঢুকে সাংগঠনিক কথা শুরু করলে তিনি হটাৎ মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন।মোমবাতি নিভানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,বন্যার্ত মানুষের জন্য সংগৃহীত রিলিফের টাকা দিয়ে মোমটি কেনা হয়েছে।রিলিফের টাকায় কেনা মোম দিয়ে সাংগঠনিক কাজ করা ঠিক নয়।পরে তিনি সংগঠনের টাকায় কেনা মোম জ্বালালেন।বন্যাটি ছিল ১৯৬৭ সালের।এ থেকে তার অত্যধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিচয় পাওয়া যায়”।মালেক ভাইয়ের সেদিনের স্মৃতি আজও আমাকে অনেক বেশী নাড়া দিয়ে থাকে।

১০.আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব:

শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান আব্দুল মালেক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন,“আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন জিঞ্জিরা(কেরানীগঞ্জ)পি এম হাই স্কুলে আয়োজিত এক শিক্ষা শিবিরে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মালের ভাই।আমিও যোগদান করেছিলাম সেই শিবিরে।আমার মনে হয় সেখানে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ কর্মী।রাতে খাবার পর হাত ধৌত করার সময় মালেক ভাইকে দেখলাম তিনি নিজে থালা বাসন পরিস্কার করছেন।এসএসসি পরীক্ষা শেষে আমি আরো একটি শিক্ষা শিবিরে অংশ নিয়েছিলাম।শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সেই শিক্ষা শিবিরের পরিচালক ছিলেন।রাতে মালেক ভাইয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ১১২ নম্বর কক্ষে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হলো।আমার সাথে আমার এক সঙ্গীও সেখানে ছিল।রাতে প্রোগ্রাম শেষে আমরা শয়ন করলাম মালেক ভাইয়ের সিটে।লক্ষ্য করলাম অনেক রাতে তিনি শুতে আসলেন।অতঃপর মাথায় পত্রিকার কাগজ দিয়ে ফ্লোরে একটি চাঁদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।এক রাতের ঘটনা।আমার সঙ্গীটি হটাৎ বিছানা থেকে পড়ে গেলেন।আর মালেক ভাই নীচে থেকে তাকে পাজাকোলে ধরে ফেললেন।ফলে সেই ভাইটি কোন ব্যথা পায়নি।জামালপুরে আশেক মাহমুদ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন একদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠে দেখি ছাত্রাবাসে আমার কক্ষের সামনের বারান্দায় একটি হালকা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে মালেক ভাই।আবেগে অভিভূত হয়ে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।খুব অভিমানে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষণ দাড়িয়েছেন,ডাক দিলেন না কেন?তিনি জবাবে বললেন তিনটার দিকে পৌঁছেছি।ভাবলাম সকালে তো ফজরের নামাজ পড়তে উঠবেই।তাছাড়া চিন্তা করলাম অনেক পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়েছ,তোমার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে লাভ কি?দুইজনের বদলে একজন কষ্ট করাই ভালো।তাই এখানে দাঁড়ালাম।আমার কিছু অসুবিধা হয়নি।

১১.নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা:

শহীদ আব্দুল মালেক একজন নীরব ও নির্ভরযোগ্য কর্মী ছিলেন।অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও তিনি কখনো গর্ব করে বেড়াতেন না।তিনি শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করেই সামনের দিকে এগুতে চাইতেন।শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের দায়িত্বশীল আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন- আব্দুল মালেক ভাই ঢাকা শহর শাখার অফিস সম্পাদক থাকা অবস্থায় অল্প সময়ের মধ্যেই সেই অফিসের চেহারা পাল্টে দিলেন। আব্দুল মালেকের সহযোগিতায় ঢাকা শহর শাখার পর পর তিনজন সভাপতি যত সহজে বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন তেমন আরামে ও সহজে গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ কোনদিন কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নাই।

তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরো লিখেছেন- ‘‘তুমি পরে এসে আগে চলে গেছো, আল্লাহর দরবারে অনেক বড় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছ, তাই তোমাকে বড় ঈর্ষা হয়। শাহাদাতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে, একনিষ্ঠ সহকারী হিসেবে নির্দেশ দিয়েছি।কিন্তু আল্লাহর দরবারে শাহাদাৎ কবুলের মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে নেতা মানছি।তোমার কর্মতৎপরতা, আত্মগঠনে নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের প্রশ্নে সতর্কতা ও ন্যায়নিষ্ঠার যে উদাহরণ তোমার জীবন থেকে আমি পেয়েছি তা সাধ্যমত নিজে অনুসরণ করা ও অন্যকে অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাকে আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি।”

১২.মানবদরদী:

ইসলামী আন্দোলনের একজন উদীয়মান কর্মী হিসেবে তাঁর মন ছিল মানবতার দরদে ভরপুর। দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অবস্থা জানাও ছিল তাঁর অন্যতম কর্মসূচি।আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী লিখেছেন-‘‘ঈদুল আজহা উপলক্ষে কর্মীরা বাড়িতে যাচ্ছে। রাতের ট্রেনে আব্দুল মালেক বাড়ি যাবেন শুনেছি। দু’একদিনের মধ্যে দেখা হয়নি।সময় মতো স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম।আব্দুল মালেককে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে।কারণ তিনি মধ্যম শ্রেণীতে উঠেননি।আমাকে দেখে তিনি বেশ অপ্রস্তুত হলেন।আমার স্টেশনে যাওয়া তাঁর কাছে কেমন যেন লেগেছে।বেশ একটু জড়সড় হয়ে বলতে লাগলেন, আপনি স্টেশনে আসবেন জানলে আমি যে করেই হোক দেখা করেই আসতাম।অবশ্য একবার খোঁজ করেছি আপনাকে পাইনি।আমি কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে কামরাটার দিকে ভালো করে দেখছিলাম।তিল ধরনের জায়গা নেই।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে সারারাত।আমি চেষ্টা করলাম ইন্টারে জায়গা করে দেয়ার।টিকিটের ঝামেলাও চুকিয়ে দেয়া যেত।কিন্তু রাজি করানো সম্ভব হলো না।আব্দুল মালেক অকপটে বলেই ফেললেন, এই লোকগুলোর সাথে আলাপ করলে আমার ভালো লাগবে।তখনো বুঝতে পারিনি কত মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছে এই কথাগুলো শুনছি।’’

১৩.দৃঢ়তা ও আপোষহীনতা:

শহীদ আব্দুল মালেক জানতেন যে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া মানেই কঠিন পরীক্ষাকে মাথা পেতে নেয়া।সেটা জেনে পথ চলার কারণেই কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁর পথ আগলে রাখতে পারেনি।ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপোষহীন, নির্ভীক।পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন সম্মুখ পানে।তাঁর বলিষ্ঠতা, আত্মবিশ্বাস এবং সংগ্রামী চেতনার পরিচয় মিলে নিম্নের এই বক্তব্যের মাধ্যমে-

শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (রাহ.)এক সময়ে শহীদ আব্দুল মালেক ভাই সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন : আমি যখন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দিলাম তখন এক কর্মী শিক্ষা শিবিরে ঢাকায় আসলাম। আব্দুল মালেকের কথা শুনেছি কিন্তু তাঁকে তখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষা শিবিরের ব্যবস্থাপক।কিন্তু প্রায় তাঁকে দেখা যেত না। শেষ দিনে এসে তিনি একটা ছোট্ট বক্তব্য দিলেন। তাঁর বক্তব্যটা ছিল এরকম-

‘‘আমরা তো জেনে বুঝেই এ পথে এসেছি। এই পথ থেকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে অনেকদূর পথ পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সামনের দিকে তাকালে মনে হবে আমাদের আরও অনেক পথ চলতে হবে। এই পথে চলতে গিয়ে যদি আমরা দ্রুতগামী কোনো বাহন পাই তাহলে সেটাতে সওয়ার হয়েই মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছবো, যদি তেমনটা না পাই তাহলে শ্লোথ কোনো বাহনে করে হলেও আমরা সেই মঞ্জিলে পৌঁছার চেষ্টা করবো”।সত্যিই আব্দুল মালেককে কোনো কিছুই ভড়কে দিতে পারেনি। তিনি পাহাড়ের মতো অটল অবিচল থেকে দ্বীনের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।

১৪.দাওয়াতী চরিত্র:

দ্বীনের দাওয়াতী কাজে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন শহীদ  আব্দুল মালেক । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানরসায়ন বিভাগের সেরা ছাত্র হয়েও দেখুন তিনি কিভাবে দাওয়াতী তৎপরতায় শামিল ছিলেন  এবং দাওয়াতী কাজের প্রতি তাঁর পেরেশানী কেমন ছিলো।

# মাসের এক তারিখেই তিনি লিস্ট করে ফেলতেন কোন কোন ছাত্রদের কাছে তিনি দাওয়াত পৌঁছাবেন।লিস্ট অনুসারে বেরিয়ে পরতেন কাজে।একদিন তার এক বন্ধু সন্ধ্যায় গিয়ে দেখলেন মালেক ভাইয়ের মন অনেক খারাপ।চোখে জল টলমল করছে। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, আগামী কাল থেকে ক্যাম্পাস দু’তিন দিনের জন্য বন্ধ থাকবে।তিনি তার লিস্ট অনুসারে সবার কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে পারেননি বলে তার মন খারাপ।মন বেশী খারাপ হয়েছে তাদের জন্য যাদেরকে সবে দাওয়াত দিয়েছেন।এখন তাদের সাথে দু’তিন দিন দেখা সাক্ষাৎ না থাকা মানে তারা আবার নতুন হয়ে যাবে।

# আব্দুল মালেক ভাই সবাইকেই সালাম দিতেন।এক নাস্তিক তাকে একদিন বলল, আমি সালাম নেইনা তবুও আপনি আমাকে বার বার সালাম দেন কেন ? তিনি বললেন, সালাম মানে তো শান্তি কামনা করা।আমি কেন আপনার শান্তি কামনা করবনা ? এভাবেই কথা শুরু।অবশেষে একদিন এই নাস্তিকটিও ইসলামী আন্দোলনের পথে এসেছিলেন আব্দুল মালেক ভাইয়ের দাওয়াতী তৎপরতার কারনে।মালেক ভাইয়ের মতে, সালাম দিলে কথা বলার একটা সুযোগ এসে যায় আর তাতে দাওয়াতী কাজ করা সহজ হয়ে যায়।

# আব্দুল মালেক ভাইয়ের দাওয়াতে একজন কর্মী হয়েছেন।কিন্ত সেই কর্মী কিছুতেই ফজরের নামাজ পড়তে পারে না। বার বার ক্বাযা করে ফেলে।মালেক ভাই বিচলিত হয়ে পড়েন তার নামাজ ক্বাযা বন্ধ নিয়ে।মালেক ভাই থাকতেন ফজলুল হক হলে আর সেই কর্মী থাকতো পুরোনো ঢাকায়।তথাপিও মালেক ভাই প্রতিদিন ফজরের নামাজ পরতেন সেই কর্মীর মেসের পাশের মসজিদে তাকে সাথে নিয়ে।এভাবে প্রায় কয়েকমাস।অবশেষে কর্মীটি সাথী শপথ নিতে সমর্থ হয়।

# আব্দুল মালেক ভাই গভীর রাতে জায়নামজে বসে কাঁদতেন নিজের গুনাহ মাফের জন্য, ইসলামী আন্দোলনের জন্য, বিশ্ব মুসলিমদের জন্য।আর একটি বিষয় নিয়েও কাঁদতেন।সেটি হল তার দাওয়াতী কাজের সফলতার জন্য।যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর চিন্তা করতেন তাদের নাম ধরে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে হেদায়াতের জন্য দোয়া করতেন।

# দাওয়াতী কাজ ছিল শহীদ আব্দুল মালেক ভাইয়ের প্রাণ।সে কারনেই তিনি বলেছিলেন, আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব আমার ডান হাত দিয়ে, ইসলামের শত্রুরা যদি আমার ডান হাত কেটে ফেলে তাহলে বাম হাত দিয়ে ডাকব, ওরা যদি আমার বাম হাতও কেটে ফেলে দুটো পা দিয়ে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে ডাকব।ওরা যদি আমার দুটো পাও কেটে ফেলে তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি ছেলেকে ইসলামের দিকে ডাকব। ওরা যদি আমার চলার গতিকে স্তব্ধ করে দেয়, তাহলে আমার যে দুটি চোখ বেঁচে থাকবে সে চোখ দিয়ে হলেও ছাত্রদের ইসলামের দিকে ডাকব,আমার চোখ দুটিকে যদি উপরে ফেলে তাহলে আমার হৃদয়ের যে চোখ রয়েছে তা দিয়ে হলেও আমি আমার জীবনের শেষ গন্তব্য জান্নাতের দিকে তাকিয়ে থাকবো।

১৫.ইকামতে দ্বীনের কাজকে অগ্রাধিকার:

পৃথিবীর সকল কাজের মধ্যে ইকামাতে দ্বীনের কাজকেই সবচেয়ে বেশী প্রিয় করে নিয়েছিলেন শহীদ আব্দুল মালেক।দ্বীনকে তিনি অন্যতম নয় বরং একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। আর এ উদ্দেশ্য পূরণে বাধা হিসেবে যা কিছু সামনে এসেছে তা মাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন।বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই বাবার কাছে চিঠি লিখেছিলেন, পাক জনাবেষু, ‘বাড়ির কথা ভাবিনা, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য, খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন।কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ,দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন।আমি ধন-সম্পদ কিছুই চাই না,শুধু মাত্র যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি’।

কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করলেন তখন তার এ সংকল্প আরও দৃঢ় হল।তাইতো ফজলুল হক হলের ১১২ রুমের দরজার উপর লিখে রেখেছিলেন শহীদ সাইয়েদ কুতুবের সেই বিপ্লবী বাণী “আমরা ততদিন পর্যন্ত নিস্তব্ধ হবনা, নীরব হবনা, নিথর হবনা, যতদিন না কোরআনকে এক অমর শাসনতন্ত্র হিসেবে দেখতে পাব।আমরা এ কাজে হয় সফলতা অর্জন করব নয় মৃত্যবরণ করব।” এ মহান মঞ্জিলে পৌছার জন্য মায়ের বন্ধনও ছিন্ন করার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলেন তিনি।১৯৬৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী তাঁর বাবার কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছেন, “মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই।আশীর্বাদ করবেন,সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি।আমার মা এবং ভাইরা আশা করে আছেন,আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা।আমি চাইনে বড় হতে, আমি ছোট থেকেই স্বার্থকতা পেতে চাই।বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে বিলেত থেকে ফিরে যদি বাতিল পন্থীদের পিছনে ছুটতে হয়, তবে তাতে কি লাভ?

১৬.পরিশ্রম প্রিয়তা:

শহীদ আব্দুল মালেক ভাই ছিলেন অনেক বেশী পরিশ্রমী। নূর মুহাম্মদ মল্লিকের ভাষায়, ‘ তাঁকে দেখতাম সারাদিন এবং অধিকাংশ রাতভর কত কাজ করতে।ক্লাস করছেন, সময় পেলে পড়ছেন। এরপর আন্দোলনের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করছেন।রাতে হয়তো পোস্টারও লাগাচ্ছেন কর্মীদের সাথে।মনে পড়ে মালেক ভাই অনেক  সময় পোস্টার লাগাবার পর অন্যান্যদের কাজ শেষ করার পূর্ব পর্যন্ত একটু সময় পেতেন, তখন সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে অথবা পীচঢালা নির্জন পথে একটু বসে বিশ্রাম নিতেন।”

১৯৬৯ সালের ৩১ শে মে প্রিয় বেলালকে আব্দুল মালেক ভাই লিখেছেন-মনের অবস্থাটা খুব বেশী ভাল নয়।এ কথাটা কাউকে বলতেও পারছিনা।বিরাট আন্দোলনের নগন্য এক কর্মী আমি ।ঢাকা ইসলামী ছাত্রসংঘের মত বিরাট সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব আমায় হাঁপিয়ে তুলেছে।সবাই কর্মী আর এই কর্মীদের পরিচালনার গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধেই চেপেছে।তাই মন খারাপ থাকলেও কর্মীদের সামনে জোর করে হাসতে হয়।শরীর খারাপ থাকলেও জোর করে বাইরে বেরুতে হয়।কারণ আল্লাহর দ্বীনের এ আন্দোলনের সামান্যতম ক্ষতি হোক ,এটা চিন্তা করাও মুশকিল।যখন এক থাকি,তখনই যত রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় জট পাকায়।জীবনের এক কঠিন দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আমার প্রতিটি মুহুর্ত কাটছে।

আগামী ১৫ আগষ্ট পালিত হবে শহীদ আব্দুল মালেকের ৪৬তম শাহাদাৎবার্ষিকী এবং ইসলামী শিক্ষা দিবস। শহীদ আব্দুল মালেক আজকে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রেরণা চির ভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে।শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের এতো বছর পরেও আরো বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তার কথা স্মরণ করার।তার শিক্ষাকে,তার কুরবানীকে,তার আদর্শকে,তার চরিত্রকে বর্তমান ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করার, যাতে এ দেশের ছাত্র মহলে যারা ইসলামী আদর্শের দিকে এগুচ্ছে তারা এ মহান আদর্শ থেকে যাতে বিচ্যুত না হয় এবং শহীদ মালেক যেন তাদেরকে প্রেরণা যোগায়।একজন আব্দুল মালেকের জায়গায় আজ লাখ লাখ আব্দুল মালেক ছুটে এসেছে এ আন্দোলনে। শহীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামী আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখে যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য তাঁর উত্তরসূরিরা জানবাজ চেষ্টা করছে এবং করবে। পেছন থেকে প্রেরণা যোগাবে লক্ষ কোটি শহীদের মিছিলে শামিল হওয়া শহীদ আব্দুল মালেক। মরহুম কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বললে বলতে হয়-

‘‘শহীদ মালেক আজো আমায় ডাকে

সকল বাধা পেরিয়ে যেতে

সেই দিশারী আড়াল থেকে হাঁকে …’’


 লেখকঃ-

আতিকুর রহমান 

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক। 

শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২০

একটি সাংগঠনিক সেশনে সংগঠন পরিচালনায় দায়িত্বশীলের যত কাজ- ড. মোবারক হোসাইন


সংগঠনের শাখা প্রশাখাগুলোকে লক্ষ্যানুযায়ী কাজে নিয়োজিত রাখাকে সংগঠন পরিচালনা বলে। সুন্দর পরিচালনার ওপর কাজের সফলতা নির্ভর করে। সংগঠনকে সকলের নিকট ভালোভাবে উপস্থাপনের জন্য দায়িত্বশীলদের কতগুলো বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।

পরিচালনার সাধারণ নীতি
সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের কয়েকটি মৌলিক নিয়মের ওপর দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। সেগুলো হলো-
⇒ Well Plan
⇒ Proper distribution
⇒ Supervision
⇒ Proper Analysis & Reporting
⇒ Good result = Good plan-Well Distribution-Proper Motivation

কর্মপদ্ধতি-সংবিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখা

সংগঠনের ইতিহাস জানা : ইতিহাস হলো জাতির দর্পণস্বরূপ। এর মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে বিগত দিনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিকথা। তাই মানুষ ইতিহাস পাঠে সাবধানী হয়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেষ্ট, উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়। ইতিহাসকে জাতির বিবেক বলা চলে। এটা একটা জাতির দিকদর্শন যন্ত্রের মতও কাজ করে।

সংগঠনের ঐতিহ্য জানা : ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত যে ঘটনা কালের পরিক্রমায় অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে যায় তাই ঐতিহ্য।
অর্থাৎ, সময়ের আবর্তনে যেসব বিষয় শিক্ষণীয় হিসেবে পরিণত হয়েছে।

কষ্টসহিষ্ণুতা ও কষ্টপ্রিয়তা দায়িত্বশীলদের অলঙ্কার :

কষ্টসহিষ্ণুতা ও কষ্টপ্রিয়তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের বিশেষ করে দায়িত্বশীলদের অলঙ্কার। ‘৬২ থেকে ‘৬৬-এ পর্যায়ে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে কষ্টসহিষ্ণুতা ও কষ্টপ্রিয়তার বহু নজির লক্ষ্য করা যায়। তখন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের থাকা এবং খাওয়ার স্থানগুলো সাধারণত বর্তমান ঢাকা আগাসাদেক রোড, হোসনী দালান রোড ও বকশিবাজার এলাকাতেই ছিল। তখন ঢাকা বিমানবন্দর ছিল বর্তমান তেজগাঁও পুরতান বিমানবন্দর। এই সময়ের এক ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে।

ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের জন্য বাইরে থেকে মেহমান আসার কথা। বিমানবন্দরে তাঁকে রিসিভ করতে হবে। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল বকশিবাজার এলাকায় থাকেন। তাঁর পকেটে মাত্র চার আনা পয়সা। বিমানবন্দরে তাঁর সাথে যারা যাবেন তাদের পকেটেও পয়সা নেই। তারা ত্রিসংকটে পড়লেন। ঐ চার আনা পয়সা দিয়ে নাস্তা করলে বিমানবন্দরে যাতায়াতের খরচ থাকে না। আবার বিমানবন্দরে গেলে নাস্তা খাওয়া যায় না। খরচ করে ফেললে পকেট শূন্য হয়ে যায়। ফলে মেহমানকে নিয়ে আসবে কিভাবে?

তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন নাস্তা না খেয়ে বকশিবাজার থেকে হেঁটে তারা বিমানবন্দরে যাবেন। অভুক্ত অবস্থায় তারা হেঁটে হেঁটেই বিমানবন্দরে পৌঁছলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ঐদিন বিমান বিলম্ব করল। ফলে অভুক্ত অবস্থায়ই তাদেরকে মেহমানের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে মেহমান এলেন। মেহমান অবশ্য খুবই বিচক্ষণ ছিলেন। তিনি উপস্থিত দায়িত্বশীলদের দেখে বুঝতে পারলেন যে, তারা অভুক্ত। অতঃপর তিনি নিজ খরচে নাস্তা করালেন। এ ঘটনা তীব্র আর্থিক সঙ্কটেও দায়িত্ব পালনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে তুলে ধরে।
কাজ না হওয়ার কারণ দু’টি: ক) অলসতা ও খ) কাজ না বুঝা।

একটি সাংগঠনিক সেশনে যত কাজ

♣ সেটআপ সম্পন্ন করা:
⇒ দ্রুত সময়ে সেটআপ সম্পন্ন করা।
সেটআপ প্রস্তাবনা/পদ্ধতি:
⇒ আগে নিজে চিন্তা করা
⇒ সেক্রেটারি ভাইয়ের সাথে সমন্বয় করা
⇒ ঊর্ধ্বতনের অনুমতি নেয়া
⇒ পরামর্শ সভায় উপস্থাপন
⇒ সদস্য বৈঠকে উপস্থাপন
⇒ ইনসাফ করা।
⇒ দু’জন পারফেক্টের মাঝে সিনিয়রকে অগ্রাধিকার দেয়া।
⇒ স্বজনপ্রীতি না করা।
⇒ যাকে দায়িত্বশীল বানাচ্ছেন তার খোঁজ-খবর রাখা (লেনদেন, নৈতিকতা ও আনুগত্য)।
⇒ ভালো মানের সেকেন্ডম্যান দেয়া।
⇒ থানা/ওয়ার্ড/উপশাখা পর্যায়ে সেটআপ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা।

♣ পরিকল্পনা প্রণয়ন:
⇒ সক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ।
⇒ কর্মপদ্ধতি নির্দেশিত পরিকল্পনার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ:
⇒ কাজের পরিধি ও পরিসংখ্যানমূলক তথ্য:
⇒ প্রতিষ্ঠানের তালিকা ও ছাত্রদের পরিসংখ্যান
⇒ আবাসিক এলাকার তালিকা
⇒ প্রশাসনিক ওয়ার্ড ইউনিয়ন
⇒ ওয়ার্ড ও উপশাখার শ্রেণীবিন্যাস

♣ মানোন্নয়ন:
⇒ বিভিন্ন রেশিও (কমপক্ষে) নিশ্চিতকরণ:
⇒ মানোন্নয়ন রেশিও- ৩:২:১
⇒ সমর্থকবৃদ্ধির রেশিও- ১২:১০:৫
⇒ বন্ধুবৃদ্ধির রেশিও- ২০:১৫:১০
⇒ টার্গেটকৃত ছাত্রের ৫টি গুণাবলির দিকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ।
⇒ মানোন্নয়নের জন্য প্রত্যেক জনশক্তি কমপক্ষে তিনজনকে টার্গেট নিবেন (মেধাবী, প্রভাবশালী ও সাধারণ)।
⇒ থানা ওয়ার্ড ও উপশাখাভিত্তিক পরিকল্পনা নিশ্চিত করা।
⇒ জনশক্তির তালিকা ধরে, বৈঠকের পূর্বেই সভাপতি পরিকল্পনা তৈরি করবেন।
⇒ ধারাবাহিক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক বৈঠকে পর্যালোচনা প্রয়োজন।
⇒ মান নিশ্চিত করে মানোন্নয়ন (জ্ঞান, আমল, ময়দান):

♣ জ্ঞানগত যোগ্যতা:
⇒ সহীহ কুরআন তিলাওয়াত
⇒ দারস ১৫+১৫টি। নোটবই ১৫টি + আলোচনা ১৫টি। মুখস্থÑআয়াত ৮০টি ও হাদিস ৩৫টি।
⇒ ধারাবাহিকভাবে সিলেবাস শেষ করা।
⇒ মাসিক সাহিত্য অধ্যয়নের রেশিও- ৩০০: ২০০: ১০০ (সদস্য: সাথী: কর্মী)।
⇒ মৌলিক বইসমূহ বুঝে পড়া ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুখস্থ করা।
⇒ সাংগঠনিক সকল বিষয়ে ক্লিয়ার ধারণা নেয়া।
⇒ জনশক্তির পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি। রাসূল (সা:)-এর আদর্শ ও সাহাবীদের জীবনচরিত অধ্যয়ন করা।
⇒ ভাষা, প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতা অর্জন করা।

♣ আমল:
⇒ নামাজসহ মৌলিক ইবাদত (নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, নফল রোজা)।
⇒ পর্দা (৩য় শ্রেণীর ওপর ছাত্রী না পড়ানো)।
⇒ আনুগত্য।
⇒ মুয়ামেলাত।
⇒ পরীক্ষায় নকল না করা।

♣ ময়দানে ভূমিকা:
⇒ নিয়মিত মানোন্নয়ন।
⇒ দাওয়াতি কাজ।
⇒ কাজ করা ও করানোর যোগ্যতা।
⇒ আর্থিক ও অফিসিয়াল হিসাবে সংরক্ষণে পারদর্শী হওয়া।

♣ সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া:
⇒ থানা, ওয়ার্ড, উপশাখা দায়িত্বশীল টিএস।
⇒ হাতে-কলমে কাজ শেখানো।
⇒ রিপোর্ট বুঝানো।
⇒ ভাউচার করা শেখানো।
⇒ লেজার মেন্টেইন শেখানো।
⇒ দাওয়াতি কাজ সাথে থেকে শেখানো।
⇒ বিভাগগুলোর কাজ বুঝিয়ে দেয়া (বিএম, শিক্ষা, সাহিত্য, প্রকাশনা, অফিস, স্কুল)।
⇒ কেন্দ্রের নিদের্শনা যথাযথভাবে উপস্থাপনা।
⇒ প্রোগ্রামের শেষে ১০-১৫ মিনিট বক্তব্য শুধু নয়, বৈঠকের শুরু থেকেই থাকার চেষ্টা করা।

সাংগঠনিক দশক:

♣ উদ্দেশ্য:
⇒ সংগঠন গোছানো।
⇒ ময়দানের অবস্থা চিহ্নিত করা।
⇒ সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করা।
⇒ জনশক্তির অবস্থা চিহ্নিত করা।
⇒ সংগঠনের সকল স্তরে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কাজ সৃষ্টি।

♣ কাজ:
⇒ পূর্বেই সার্কুলার দেয়া।
⇒ টিম গঠন করে থানায় প্রেরণ (শাখা + পরামর্শ সভা+ সেক্রেটারিয়েট + ভালো মানের কয়েকজন থানা সভাপতির সমন্বয়ে)।
⇒ প্রত্যেক ওয়ার্ডে একজন করে দায়িত্বশীল নির্ধারণ।
⇒ সকল জনশক্তির সাথে রিপোর্টসহ কন্টাক্ট করা (রিপোর্ট দেখবে ও প্রশ্নের উত্তর দিবে)।
⇒ ভালো মানের সমর্থককে কর্মী ঘোষণা দেয়া।
⇒ বিএম ও পাঠাগার দশক পালন করা (বিএম বাড়ানো, বইপুস্তক ও পাঠাগার বৃদ্ধি, সুধী যোগাযোগ)।
⇒ বিএম, সাহিত্য হিসাব ও অফিসিয়াল ফাইল দেখা।
⇒ পর্যালোচনা সমাবেশ করা (ওয়ার্ড ও থানা দায়িত্বশীলদের নিয়ে, সম্ভব হলে সাথী সমাবেশ করা)।
⇒ সমাবেশে রিপোর্ট পেশ করা (সমস্যা, সম্ভাবনা, পরামর্শ)।

♣ প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম:
⇒ কাজ শেখানোর লক্ষ্যে শুরুতেই দায়িত্বশীল টিএস করা: ক) থানা দায়িত্বশীল, খ) ওয়ার্ড/ইউনিয়ন দায়িত্বশীল, গ) উপশাখা দায়িত্বশীল। সকল জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা।
⇒ মার্চ মাসে সদস্য-সদস্য প্রার্থী, এপ্রিল মাসে সাথী-সাথীপ্রার্থী, মে মাসে কর্মী টিসি সম্পন্ন করা।
⇒ টিসি করতে না পারলে টিএস বা অন্য যে কোন উপায়ে উদ্দেশ্য হাসিল করা।
⇒ শব্বেদারির আয়োজন করা। কুরআন তালিম, কুরআন ক্লাস নিশ্চিত করা।
⇒ ওয়ার্ড/ ইউনিয়নে প্রতি ২ মাসে কমপক্ষে ১টি টিএস করা।
⇒ মানসম্মত স্টাডি সার্কেল ও কুরআন স্টাডি ক্লাসের আয়োজন করা।
⇒ মানসম্মত আলোচনা চক্র ও পাঠচক্র করা।

♣ সাংগঠন সম্প্রসারণ ও উপশাখা মজবুতিকরণ:
⇒ কোথায়, কোন মাসে, কার তত্ত্বাবধানে সংগঠন বৃদ্ধি ও মজবুতি হবে তা ঠিক করা।
⇒ বৈঠকে পর্যালোচনা করা।
⇒ দুর্বল উপশাখা চিহ্নিত করা।
⇒ উপশাখার মৌলিক ৪টি প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন নিশ্চিতে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা: ক) ১ম সপ্তাহে কুরআন তালিম, খ) ২য় সপ্তাহে সামষ্টিক পাঠ, গ) ৩য় সপ্তাহে সাধারণ সভা, ঘ) ৪র্থ সপ্তাহে কর্মী বৈঠক

♣ তত্ত্বাবধান ও সফর:
⇒ নিয়মিত সফরের বাইরে অনিয়মিত সফর বেশি করা।
⇒ শুধু প্রোগ্রামকেন্দ্রিক সফর নয় বরং সুধী, শহীদ পরিবার, মেধাবী ছাত্র ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের সাথে সাক্ষাৎ।
⇒ টার্গেটকৃত জনশক্তির সাথে কন্টাক্ট : ক) সিঙ্গেল ডিজিট, খ) জিপিএ-৫, গ) প্লেসধারী, ঘ) প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান।
⇒ প্রোগ্রাম ও ইস্যুভিত্তিক তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য। আয়াত-হাদিস ও ইসলামী রেনেসাঁর উদ্ধৃতি প্রদান।
⇒ ময়দানের সমস্যার আলোকে কথা বলা।
⇒ বক্তব্যের আগেই সভাপতির কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে ময়দানের অবস্থা জেনে তার আলোকে বক্তব্য দেয়া।
⇒ তত্ত্বাবধানকৃত শাখার সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে মূল দায়িত্বশীলকে জানানো।
⇒ সংগঠন সম্প্রসারণ, মজবুতি ও দাওয়াতি কাজের খোঁজ-খবর রাখা।

♣ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন:
⇒ অর্থ হলো সংগঠনের ব্লাড। জনশক্তির ৯০%, সুধীদের ৮০% বিএম আদায় নিশ্চিত করা।
⇒ অপচয় ও অপব্যয় না করা।
⇒ রসিদে আয় ও ভাউচারে ব্যয় করা, হাতে লিখা ভাউচার পরিহার করা। অপ্রদর্শিত আয় না করা।
⇒ সভাপতি নিজ হাতে ভাউচার না করা।
⇒ ঋণ না দেয়া। মানবিক কারণে যেকোন সহযোগিতা করতে হলে ঊর্ধ্বতন সংগঠনের অনুমতি নেয়া।
⇒ দায়িত্বশীল পরিবর্তনের সাথে সাথে অডিটের ব্যবস্থা করা।
⇒ অধস্তন শাখায় আয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ আয়ের ব্যবস্থা করা।
⇒ ঊর্ধ্বতন কোটা পরিশোধ ও নিজ শাখার সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোগ নেয়া।
⇒ ইস্যুভিত্তিক কালেকশন (শিক্ষা সফর, স্কুল ছাত্রদের নিয়ে প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম, সিলেবাসভিত্তিক বই ক্রয়, কুরআন হাদিসের সেট, সাইকেল ক্রয় ইত্যাদি)।

♣ সহযোগী সংগঠনের সাথে সমন্বয় করা:
⇒ সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ।
⇒ সম্মান করা, দোয়া নেয়া।
⇒ সহযোগিতা না করলে অসদাচরণ না করা, প্রকাশ্যে বা বাইরে আলোচনা সমালোচনা না করা ঊর্ধ্বতনে জানানো।
⇒ অভিভাবকদের/সাবেকদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা যাবে, তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংগঠনের নীতির আলোকে করা।

♣ দাওয়াতি কাজ (২০: ১৫: ১০ ও ১২: ১০: ৫):
⇒ প্রত্যেক জনশক্তি ১০০ জনকে দাওয়াত পৌঁছাবে।
⇒ ব্যক্তিগত দাওয়াতকে জোরদার করা। নিজ আত্মীয় প্রতিবেশী ছাত্রদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া।
⇒ যে কোন বৈঠকে ব্যক্তিগত দাওয়াতের খোঁজখবর নেয়া।
⇒ বিভিন্ন দাওয়াতি অভিযান ভালোভাবে পালন করা।
⇒ দশক শেষে ব্যাপকভাবে চা-চক্র, বনভোজন, খেলা-ধুলার আয়োজন করা।
⇒ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও প্রতিষ্ঠানে আলাদা করে দাওয়াতি কাজ দেয়া।
⇒ যত মাঠ তত টিম শ্লোগানকে বাস্তবায়ন করা।
⇒ সোমবারকে দাওয়াতি বার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
⇒ সমর্থক ফরম পূরণ করেই সমর্থক বানানো।
⇒ দায়িত্বশীল ভাইয়েরা একেক দিন একেক এলাকায় দাওয়াতি দশকে সরাসরি অংশ নিবেন।
⇒ প্রত্যেক মাসে দাওয়াতি সপ্তাহ, দশক অথবা ৩/৪ দিন নির্ধারিত করা

♣ পার্শ্ব/সাইড সংগঠন পরিচালনায় গুরুত্ব দেয়া:
⇒ প্রত্যেক সাইড সংগঠনকে সমান গুরুত্ব দেয়া।
⇒ ভালো মানের জনশক্তি দেয়া।
⇒ অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেয়া।
⇒ নতুন নতুন সাইড সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা।

♣ সমাজসেবা:
⇒ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায়তা ও সামাজিক সমস্যাসমূহ সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ।
⇒ ব্যনারসর্বস্ব প্রোগ্রাম না করে ঊর্ধ্বতন সংগঠনের সার্কুলারের যথাযথ আনুগত্য করা।
⇒ ছাত্র রিলেটেড সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।
⇒ বাছাইকরা মেধাবী ছাত্রদের মাঝে গাছের চারা এবং দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা।

♣ কিছু দৃষ্টিভঙ্গি:
⇒ রিপোর্ট প্রেরণের ক্ষেত্রে আমানতদারিতা ও সময়সচেতনতা বজায় রাখা।
⇒ প্রতিটি কর্মসূচি পালন করা, না পারলে ঊর্ধ্বতন সংগঠনের অনুমতি নেয়া।
⇒ যে কোন মূল্যে ঊর্ধ্বতন কোটা ফিলাপ করা এক্ষেত্রে মওকুফ চাওয়ার মানসিকতা পরিহার করা।
⇒ কম হোক বেশি হোক প্রতি মাসেই সাহিত্য বিভাগে টাকা জমা দেয়া।
⇒ ঈদকার্ড, ক্যালেন্ডারসহ যে কোন প্রকাশনা সাময়িকী বের করতে কেন্দ্রের অনুমতি নেয়া। ঈদকার্ড বের করতে হলে শাখা সভাপতি-সেক্রেটারি আলাদা না করে একটি করা।
⇒ জনশক্তি এবং শাখাবৃদ্ধি-ঘাটতিতে অনুমতি নেয়া।
⇒ সেটাপ কিংবা সেটাপ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে অনুমোদন নেয়া।

♣ সফর:
⇒ ঊর্ধ্বতন মেহমানকে রিসিভ করার ক্ষেত্রে শাখা সভাপতি যাওয়া।
⇒ সভাপতি যেতে না পারলে মেহমানের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া।
⇒ নিরাপত্তা ও সফর খরচের ব্যাপারে সচেতনতা দেখানো।
⇒ বছরের মাঝামাঝি সময় শাখায় কেন্দ্রের সাংগঠনিক সফর নিশ্চিত করা।

♣ নেতৃত্ব:
⇒ চেইন অব লিডারশিপ নিশ্চিত করা।
⇒ কয়েক সেট দায়িত্বশীল তৈরি করা।
⇒ নেতৃত্ব বাছাই (কর্মী, সাথী ও সদস্যদের মাঝে)।
⇒ প্রতি বর্ষে দায়িত্বশীল তৈরি করা।
⇒ নেতৃত্বের উপযোগী করে তৈরি করা।
⇒ সহযোগিতা প্রদান ও কাজ শিখানো।

♣ টেবিল ওয়ার্ক:
⇒ আদর্শের মধ্য থেকে নতুন নতুন চিন্তা নিয়ে।
⇒ নিয়মিত প্রোগ্রাম, অধস্তন সংগঠন, জনশক্তির সমস্যা নিয়ে।
⇒ নতুন নতুন প্রোগ্রাম চালু করা নিয়ে।
⇒ প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগানো নিয়ে।

♣ রিপোর্টিং:
⇒ পরিশীলিতভাবে রিপোর্টিং।
⇒ ঊর্ধ্বতন কোঠাসমূহ যথাসময়ে পরিশোধ।
⇒ যথাসময়ে রিপোর্ট জমার ব্যবস্থা করা।
⇒ যে শাখায যথাসময়ে রিপোর্ট জমা দেয় না সে শাখায় আগেই তত্ত্বাবধায়ক যাওয়া।

♣ পরবর্তী দায়িত্বশীল গড়ে তোলা যায় কিভাবে?
⇒ যথার্থ লোক বাছাই
⇒ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দান
⇒ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভে উদ্বুদ্ধ করা
⇒ সাংগঠনিক প্রজ্ঞা সৃষ্টি
⇒ দায়িত্বশীলের প্যানেল বা চেইন তৈরি করা
⇒ কাজ দিয়ে তত্ত্বাবধান
⇒ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলা
⇒ পরিশ্রমপ্রিয় হিসাবে গড়ে তোলা
⇒ কর্মীদের একেবারে কাছে অবস্থান
⇒ দক্ষতা অর্জনের বাস্তব পদ্ধতি গ্রহণ

♣ সংগঠন শৃঙ্খলার উপাদানসমূহ:
⇒ আনুগত্য
⇒ পরামর্শ
⇒ এহ্তেসাব
⇒ পারস্পরিক সম্পর্ক

♣ সাংগঠনিক সেশনে পরিকল্পনা গ্রহণে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ:
ষ সংগঠন পরিচালনা আরো একধাপ নিয়ে যাওয়ার জন্য কতগুলো দিক আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবে, যা সংগঠনকে আলোকিত এবং সুন্দর করতে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে।

♣ MOST
M= Mission (Where the organization intends to go)
O=Objectives (The key goal which will help achieve the mission)
S=Strategies (options for moving forward)
T=Tactics (how Strategies are put into action)

♣ SWOT
S=Strengths, W= Weakness, O= Opportunities, T= Threats

♣ MoSCoW Techniques ফলো করতে হবে- 1. Must have, 2. Should have, 3.Could have, 4.Won’t Have this time.

সংগঠন পরিচালনার জন্য সংগঠনের সমগ্র বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকতে হবে এবং সংগঠনের লক্ষ্য মিটানোর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
⇒ Creating and maintaining the organization architecture.
⇒ Conducting sensibility study.
⇒ Identifying organizational opportunities.
⇒ Preparing the organization case.
⇒ Conducting the initial risk assessment.
3P = Purpose, Process, Product
3R = Read, Reflection, Reformed
3H = Head to understand, Heart to accept, Hand to act
7S = Strategy, Structure, System, Style, Staff, Skill, Sharevalues
POSDCORB =Plaining, Organizing, Staffing, Directing, Coordinating, Reporting, Budgeting

বর্তমান পরিস্থিতি ইসলামী আন্দোলনের জন্য পরীক্ষা, প্রত্যেক জনশক্তিকে চারটি বিষয়ে অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে-
⇒ নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন ও সহীহ তেলাওয়াত, হাদিস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন।
⇒ জামায়াতে নামাজ (নফল ইবাদত সহ- তারাবিহ ও শববেদারি)।
⇒ ব্যক্তিগত দাওয়াতি কাজ- কুরআন বিতরণ, বই বিতরণ ও উপহার সামগ্রী বিতরণ।
⇒ নিয়মিত ছাত্রকল্যাণ ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজ।

শত শত শহীদের স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আমাদের। তাই আমাদেরকে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে-
⇒ আমাদের নৈতিক মান এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে যাতে জনগণ আমাদের ওপর আস্থাশীল হয়। এককথায় আমাদের হতে হবে ইসলামের প্রতীক।
⇒ মেধাবী ও নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন ছাত্রদেরকে বিশেষ টার্গেট করে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এককথায় পরিমাণের চেয়ে গুণাবলির দিকে বেশি নজর দিতে হবে। কাজের মানদণ্ড শুধু জনশক্তি বৃদ্ধি নয় বরং সমাজ বিনির্মাণে পরিমিত লোক সাপ্লাই অন্যতম মানদণ্ড।
⇒ এখন থেকে কর্মীদেরকে গাইডলাইনের মাধ্যমে কর্মীদের ক্যারিয়ার তৈরিতে সহযোগিতা করা।
⇒ আমাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক, তাই শত শত শহীদের স্বপ্ন আমাদেরকে পূরণ করতে হবে।
⇒ তৃণমূল পর্যায়ে- ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি ও ইসলামের প্রতি বলিষ্ঠ আস্থা সৃষ্টিতে আমাদেরকে আরও বাস্তবমুখী ও গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
⇒ ‘The word is a global village now’ এ গ্রামের নীতি নির্ধারণে আমাদেরকে সক্ষম, সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ বাসিন্দা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

⇒ ‘We are facing a very decisive war and this was a truly intellectual war’ এ যুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে জ্ঞান বুদ্ধি ও দক্ষতার অস্ত্রে পূর্ণরূপে সজ্জিত হতে হবে।
⇒ জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির অতুল ভাণ্ডার কুরআন ও হাদিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতে হবে। দুনিয়াকে জানা, বুঝা এবং এর চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করতে হবে।
⇒ বিবেক ও বাস্তবতার নিরিখে আবেগকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে দূরদর্শিতার সাথে পথ চলা।
⇒ মনে রাখতে হবে জ্ঞান ও বুদ্ধির অস্ত্রে সজ্জিত গতিশীল ও ভিশনারি লোকেরাই বিশ^কে নেতৃত্ব দেবে।
⇒ আমাদের যোগ্যতা ও প্রস্তুতির তুলনায় চ্যালেঞ্জ হলো পর্বত পরিমাণ। তাই সময়োপযোগী জ্ঞান ও যোগ্যতার কোন বিকল্প নেই।
⇒ জাতির কল্যাণকামী এবং শক্তিশালী এক ছাত্রসংগঠন হিসেবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
⇒ জ্ঞান ও চিন্তার জগতে আমাদেরকে দিকনির্দেশনার কথা ভাবতে হবে। চিন্তার জগৎকে যেমন একদিকে প্রসারিত করতে হবে, অন্যদিকে বাস্তবমুখীও করতে হবে।

⇒ যোগ্যতার সুউচ্চ চূড়ায় আরোহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে ‘যোগ্যতমের বেঁচে থাকা’। দ্বীনের ব্যাপারে যেমন পাগলপারা হতে হবে তেমনি দুনিয়াবি যোগ্যতার বেখেয়াল হলে চলবে না।
⇒ আমরা পেশিশক্তি দিয়ে নয়, চারিত্রিক সুষমা দিয়ে বিশ^ জয় করতে চাই। সততা ও চরিত্রের অনন্য সুষমায় অভিষিক্ত হতে হবে।
⇒ আমাদেরকে পরিকল্পিত জীবনগঠনে প্রত্যয়ী হতে হবে। পরিকল্পনাহীন জীবনে সাফল্য অনিশ্চিত।
⇒ সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কোন আগামীকাল নেই। ‘এখন নয় তো কখনই নয়’, এটাই বিবেকীদের স্লোগান। মনে রাখতে হবে একটি দিন শুধু একবারই আসে।
⇒ আখেরাতমুখী জিন্দেগি গঠন করতে হবে। তাহলেই অর্জিত হবে প্রকৃত সাফল্য।
⇒ সর্বোৎকৃষ্ট জান্নাতি সাংগঠনিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
⇒ আমাদের উন্নত আখলাক, উত্তম আচরণ দাওয়াতি কাজের অন্যতম হাতিয়ার।



লেখক,
ড. মোবারক হোসাইন
পিএইচডি গবেষক