Close
সাম্প্রতিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সাম্প্রতিক লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

একুশ শতকের এজেন্ডা || আবুল আসাদ



একুশ শতকের এজেন্ডা
আবুল আসাদ

অস্তায়মান বিশ শতকের উপসংহার থেকেই গড়ে উঠবে একুশ শতকের যাত্রাপথ। তাই এই উপসংহারের স্বরূপ সন্ধান খুবই জরুরী। আমেরিকান এক লেখক তার এক শতাব্দী-সিরিজ গ্রন্থে শতাব্দীর 'Mega Trend' গুলোকে তার মত করে চিহ্নিত করেছেন। এই 'Mega Trend' গুলোর মধ্য রয়েছেঃ

১. বিশ্ব অর্থনীতি
২. বিশ্ব রাজনীতি
৩. বিশ্ব সংস্কৃতি

এই 'Mega Trend' গুলো বিশ শতাব্দীর অনন্য কারিগরি, বৈষয়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এবং এই উন্নয়নের স্রোতে বহমান জাতিসংঘের অনন্য ভূমিকার দ্বারা প্রতিপালিত ও পরিচালিত হয়ে আগামী শতাব্দীর সিংহদ্বারে এক বিশেষ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই রূপের নির্ণয়ই একবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে দিতে পারে।

প্রথমে বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের গতি-প্রকৃতির প্রশ্ন আসে। আশির দশকের শুরুপর্যন্তবিশ্ব দুই অর্থনীতি- পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের সংঘাতে সংক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু তারপর মুক্তবাজার অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য গ্রাসে সমাজবাদী অর্থনীতির পতন শুরুহলো। আশির দশকের সমাপ্তিতে এসে তা সমাপ্তও হয়ে গেল। আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির গ্রাসে গোটা পৃথিবী। মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূল কথা হলোঃ শক্তিমান অর্থনীতি বিজয় লাভ করবে, পরাজিত হবে দুর্বল অর্থনীতি। এই পরাজয়ের ভয় দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করে তুলবে এবং সেও উন্নীত হবে বিজয়ীর আসনে। তাই সবাইকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্রোতে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই তত্ত্ব কথায় উলিখিত 'আইডিয়াল সিশুয়েশন' হয়তো কোনদিন আসবে কিংবা আসবেই না। তবে তার আগেই শক্তিমান অর্থনীতির করাল গ্রাসে আত্মরক্ষার অধিকারহীন দুর্বল অর্থনীতি পরাধীন হয়ে মরার মত বেঁচে থাকার পর্যায়ে চলে যাবে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ মুক্ত বাজার অর্থনীতি গলাধঃকরণ করে ইতোমধ্যেই বিদেশী পণ্য বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় বাজার না পাবার আশংকায় বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আসবেনা বরং তা যাবে বাজার দখলকারী দেশের পুজিপতিদের কাছে। যাওয়া শুরুহয়েছে। যে বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার কথা ছিল তা গিয়ে বিনিয়োগ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। এর অন্যথা না ঘটলে অব্যাহত এই প্রবনতা বাংলাদেশকে শিল্প পণ্যের ক্রেতা এবং কৃষিপণ্যের বিক্রেতায় রূপান্তরিত করবে।

বলা হচ্ছে, এই বিনাশ হতে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে 'ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন' (W.T.O)। কিন্তু জাতিসংঘের মত এই সংস্থাও শক্তিমানদের দ্বারা পরিচালিত এবং শক্তিমান অর্থনীতিরই স্বার্থ পুরা করবে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থা মুক্তবাজার বাণিজ্যের বিশ্বনিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মরক্ষায় উদ্বুদ্ধ দুর্বল অর্থনীতির বেয়াড়াপনাকে শায়েস্তা করার জন্য বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে পারবে হয়তো 'মহান' মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল্যবান স্বার্থেই।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই বিশ্বরূপ বিশ্বে একক অর্থনীতি গড়ার লক্ষেই। যার নিয়ন্ত্রনে থাকবে আজকের শক্তিমান অর্থনীতিগুলো, আর শোষিত হবে অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী অর্থনীতির দেশসমূহ। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির শতাব্দী শেষের এটাই প্রবণতা।
এই প্রবণতা তার লক্ষে পৌঁছতে পারলে, একক এক বিশ্ব অর্থনীতি গড়া এবং তাকে এককেন্দ্রীক নিয়ন্ত্রনে আনার প্রয়াস সফল হলে বিশ্বের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার অশুভ প্রভাব নেমে আসবে।


অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী মুসলিম অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ শতকের দ্বিতীয় 'Mega Trend' হিসেবে আসে বিশ্ব রাজনীতির কথা।

ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান একটা বিশ্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। যার নেতৃত্ব দেবে ইহুদিরা এবং যার রাজধানী হবে জেরুজালেম। তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ আমি জানি না, তবে এক বিশ্ব অর্থনীতির মতই এক বিশ্ব রাষ্ট্র গড়ার ধীর ও ছদ্মবেশী প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসে ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিসংঘ এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয় করেছে যেমন কম্যুনিষ্ট সাম্রাজ্য, তেমনি জয় করবে গোটা বিশ্ব। বিশেষ সংজ্ঞায়িত এ গণতন্ত্রের আদর্শের কাছে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অধিকারকে বলি দিতে বলা হচ্ছে। বলি না দিলে শক্তি প্রয়াগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার জন্যই হাইতিতে আন্তর্জাতিক বাহিনী নামানো হয়েছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে। এমন হাইতি ভবিষ্যতে আরও অনেক হতে পারে।

গণতন্ত্র কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা হলো গণতন্ত্রের অর্থ ও রক্তস্রোতের উপর তাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রসংহতি গড়ে তুলেছে, সে রক্তস্রোত প্রবাহিত না হলে এবং সে সময় গণতন্ত্রের নীতি অনুসৃত হলে তাদের এই রাষ্ট্রসংহতি গড়ে উঠতো না। এমনকি রেড ইন্ডিয়ানদেরও একাধিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো। এই ইতিহাস তারা ভুলে গেছে। যেমন আমাদের প্রতি এখন তাদের নসীহত, বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর গায়ে আমাদের হাত দেয়া যাবে না। তথাকথিত আদিবাসি বলে তাদের মাটিতে আমাদের পা দেয়া যাবেনা। দেশের ভিতর কোন গ্রুপবা কোন ব্যক্তি যদি বিদেশী টাকার পুতুল সেজে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চায়, তাহলেও গণতন্ত্রের আদর্শের স্বার্থে তাদের জামাই আদর দিয়ে যেতে হবে।

গণতন্ত্রের দায়িত্বহীন এই আদর্শ অনুন্নত ও উন্নয়নমুখী এবং সমস্যা পীড়িত দেশ ও জাতিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এমনকি খন্ড- বিখন্ড করতে পারে। অন্তত আর কিছু না হোক বহু মত ও পথে বিভক্ত এবং দুর্বলতো করবেই। এ ধরনের দেশ ও জাতিকে তাদের স্বকীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনায়াসেই সরিয়ে আনা যায় এবং তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির উপর বিদেশী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে এনজিও প্রভাব। এরা নামে 'নন-গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন' হলেও এদের সরকারি ভূমিকা ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে। এখনি এরা সরকারি বাজেটের একটা অংশ পাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এরা সরকারের গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টর পরিচালনার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। তখন আইন শৃংখলা ও দেশ রক্ষা ছাড়া সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না। জাতিসংঘের অনুসৃত নীতি রাষ্ট্রসমূহের দেশ রক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত অথবা বিলোপ করে দিতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার কাজ অনেক আগেই শুরুকরেছে এবং শান্তিপ্রতিষ্ঠার কাজেও হাত দিয়েছে। অতএব জাতিসংঘ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে সংগত কারণেই রাষ্ট্রসমূহকে দেশ রক্ষা বাহিনী খাতে খরচ বন্ধ করতে বলতে পারে। সুতরাং সরকারের কাজ তখন হয়ে দাঁড়াবে শুধু শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা এবং সরকারের এই কাজও নিয়ন্ত্রিত হবে এনজিওদের দ্বারা। কারণ এনজিওরা গোটা সার্ভিস ও উন্নয়ন সেক্টরের মালিক হওয়ার ফলে দেশের রাজনীতি তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। আর এনজিওরা, সবাই জানেন, আর্থিক ও আদর্শগত দিক থেকে মূলত জাতিসংঘ অথবা জাতিসংঘের পরিচালক শক্তিসমুহের আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় রাষ্ট্রসমুহ কার্যতই জাতিসংঘ নামের এককেন্দ্রীক এক শক্তির অধীনে চলে যাবে। রাষ্ট্রের অন্যতম নিয়ামক হলো জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধ বিলোপ অথবা দুর্বল করারও একটা প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী চলছে। জাতিসংঘ তার উন্নয়ন, সেবা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠামুলক এজেন্সী সমুহের মাধ্যমে একটা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন গড়ে তুলছে এবং পারস্পরিক নির্ভরতার এক অপরিহার্য অবস্থা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা জাতীয় চিন্তাকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিবে এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনাকে বড় করে তুলবে। জাতিসংঘের পিছনে 'নাটের গুরু' যারা, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই 'শূন্য জাতীয়বোধ' অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।


এভাবেই পৃথিবীর আজকের শক্তিমানরা জাতিসংঘের ছায়ায় দাড়িয়ে জাতিসংঘকে নতুন এক বিশ্বরূপ দিতে চাচ্ছে। জাতিসংঘের জননন্দিত সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যামার শোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘকে হতে হবে 'বিশ্ব সংস্থা', 'বিশ্ব সরকার' নয়। সে হবে উন্নয়ন ও শান্তির সহায়তাকারী। কোনক্রমেই জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কোন সিস্টেমের ডিক্টেশনকারী নয়। কিন্তু জাতিসংঘকে আজ রাষ্ট্রসমূহকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্বের দুর্বল জাতি সমুহের মত মুসলমানদেরকেও একবিংশ শতকের এই জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

বিশ্বে এক অর্থনীতি ও এক রাজনীতির মত গোটা বিশ্বকে এক সংস্কৃতির অধীনে আনারও দুর্দান্ত প্রয়াস চলছে। এই লক্ষে দুনিয়ার মানুষের জন্য একক এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কাজ করছে। তারা চাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জন্য মূল্যবোধের একক একটি মানদন্ডনির্ধারণ করতে। এই মানদন্ডের নাম দেয়া হচ্ছে 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম'। জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত দলিল দস্তাবেজে এই তত্ত্ব দাঁড় করানো হচ্ছে যে, মানবাধিকার সকলের উর্ধ্বে। জাতীয় ধর্ম, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি অধিকার সবই এর অধীন। এই অধিকারগুলো ততটুকুই ভোগ করা যাবে, যতটুকু 'মানবাধিকার' অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের এক দলিলে এভাবে বলা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জীবন ও পরিচয়ের বিকাশসহ সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই স্বীকৃত। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকারকে সীমাহীন করা যাবে না। যখনই তা মানুষের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপকরে তখনই সাংস্কৃতিক অধিকার অচল হয়ে পড়ে। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, সাংস্কৃতিক অধিকার মানুষের মৌল স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। (United Nation Background Note-by Diana Ayten Shenker) এই দৃষ্টিভঙ্গিই জাতিসংঘের নাইরোবী সম্মেলন, কায়রোর জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলন, কোপেন হেগেনের সামাজিক শীর্ষ সম্মেলন, বেইজিং এর বিশ্ব নারী সম্মেলন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে এবং আরও হবে। উদ্বেগের বিষয় এসব সম্মেলনে সুকৌশলে প্রণীত ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (Secular Humanism) প্রতিষ্ঠার দলিলে অধিকাংশ মুসলিম দেশও দস্তখত করেছে। অথচ জাতিসংঘ প্রচারিত 'ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ' এর তত্ত্ব মেনে নিলে ইসলামকে কেটে ছোট বিকলাঙ্গ করে মসজিদে পুরে রাখতে হবে। তাদের বলা উচিত ছিল, তথাকথিত সার্বজনীন মানবাধিকার আইন নিশ্চিত ভাবেই মানব জীবন, তার স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষনকে বিপর্যন্ত ও বিপন্ন করে তুলতে পারে। ইসলামের আদর্শ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে কার্যকরভাবে যদি মানব মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয়, সেটাই হয় সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই কথা কেউ আমরা বলিনি।

এভাবে অন্য কেউও বলছে না, অন্য জাতি, অন্য ধর্মও নয়। তার ফলে, 'ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ'-ই বিশ্ব সংস্কৃতির একমাত্র মানদন্ডহয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্য কথায় এটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব সংস্কৃতি।

এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করতে পারবো না। উত্তরাধিকার আইনকে বলা হবে মানবাধিকার বিরোধী, শান্তিরআইন অভিহিত হবে বর্বর বলে, পর্দাকে বলা হবে মানবাধিকারের খেলাপ, কুরবানিকে বলা হবে অপচয় ইত্যাদি। এমনকি ইসলামের দাওয়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোথাও জাতীয় আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠিত হলে তাকে অভিহিত করা হবে মানবাধিকার বিরোধী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে। 'সেকুলার হিউম্যানিজম' প্রকৃত পক্ষে সূদুরপ্রসারী একটা ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য মানুষকে তার অলক্ষ্যে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে নেয়া। মানুষের ধর্ম না থাকলে তার জাতীয়তা ধ্বসে পড়বে। জাতীয়তা ধ্বসে পড়লে তার রাষ্ট্রও ধ্বসে পড়বে। এটাই চাচ্ছে আজকের ছদ্মবেশ নিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বনিয়ন্ত্রকরা।

বিশ্বে ধর্মসমুহকে বিশেষ করে ইসলামকে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিরোধী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে একবিংশ শতকে।

বিশেষ করে ইসলামকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, অন্য ধর্মগুলোর কোনটিই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কার্যকরী নয়। সুতরাং তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে না, করতে চাইলেও তারা পারবে না। কিন্তু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। শুধু ইসলামই তাদের চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে পারে। ইসলামের শত্রুরাও এ কথা বলছে। The End History- এর লেখক ফ্রান্সিস ফকুয়ামা কম্যুনিজমের ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য চিন্তা ধারার বিজয় প্রমান করছে যে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মতবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সব ব্যবস্থাই আজ খতম হয়ে গেছে'। কিন্তু তিনি আবার বলেছেন, তবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা একটা হবে ধর্মের সাথে আসছে একবিংশ শতাব্দীতে এবং তাঁর মতে সে ধর্ম 'ইসলাম'।

সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে, মানবতার সামনে, তার মোকাবিলা ইসলামকেই করতে হবে।

আর এ দায়িত্ব বিশ্বের মুসলমানদের। আনন্দের বিষয়, এ দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় জীবনে যে রেনেসাঁর প্রয়োজন সে রেনেসাঁ আজ সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম বিশ্বে। রেনেসাঁর নিশানবর্দার সংগঠনেরও সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম দেশে দেশে। ক্রমবর্ধমান হারে তরুনদের সম্পৃক্ততায় এ সংগঠনগুলো বিকশিত হয়ে উঠছে। ত্যাগ ও কোরবানীর ক্ষেত্রেও রেনেসাঁ-কাফেলার নিশান বর্দাররা পিছিয়ে নেই। আজ গোটা দুনিয়ায় আদর্শের জন্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিচ্ছে একমাত্র মুসলমানরাই।

তবে প্রয়োজনের তুলনায় এবং চ্যালেঞ্জের নিরিখে এটুকু যথেষ্ট নয়। এসব কাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মৌল কিছু বিষয়ে মুসলিম তরুনদের নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌল এই বিষয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়.

১. নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও তার ইতিবৃত্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন, কোরআন-হাদীস এবং মহানবীর জীবন সম্পর্কেতো অবশ্যই, ইসলামের আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ও সম্যক জ্ঞানার্জন করতে হবে।

২. ইসলামী শিক্ষার আলোকে প্রতিটি মুসলিম তরুনকে তার চারপাশে যা আছে, যা ঘটছে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নিরীক্ষনী দৃষ্টি রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব বিষয়ই এ নিরীক্ষনের ক্ষেত্রে তাদের মনে রাখতে হবে, দৃষ্টি-মনোহারীতা নয় সত্যই আসল কথা। আজ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন প্রচারণা জোরে খুব সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় গ্রহন বা বর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিবোধ সামনে রেখে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহন করতে হবে।

৩. তীব্র সাংস্কৃতিক সংঘাতের এই যুগে মুসলিম তরুনদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক নীতিবোধ ও পরিচয়কে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। আর্ট-আর্কিটেকচার থেকে শুরুকরে জীবন চর্চার সকল ক্ষেত্রে ইসলামের চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বুঝতে হবে ইসলামের সাথে অন্য সংস্কৃতিগুলোর মৌল পার্থক্য সমূহ। এই পর্যালোচনার জ্ঞান তাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমর্থ্য করে তুলবে।

৪. মুসলমানদের বিজ্ঞানের যে পতাকা ৯শ বছর আগে অবনমিত হয়েছিলো এবং সাড়ে ৬শ বছর আগে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, সেই ৪ পতাকার গর্বিত শির আবার উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য মুসলিম তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে।

৫. ইসলাম সকল যুগের সর্বাধুনিক মতবাদ। এ মতবাদকে যুগপূর্ব অচল ভাষা বা কৌশল নয়, যুগশ্রেষ্ঠ ভাষায় যুগোত্তর লক্ষ্য সামনে রেখে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু তাহলেই এই আদর্শ যুগ-চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সকল মানুষের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারবে।

এই করণীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারলে মুসলিম তরুনরা যে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে সজ্জিত হবে তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মূলতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এই চ্যালেঞ্জর মধ্যে অবশ্যই অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমরশক্তির মত দিকগুলো আছে। তবে এগুলোর অর্জন, অধিকার, ব্যবহার, কার্যকারিতা- সবকিছুই বুদ্ধির শক্তির উপর নির্ভরশীল। কম্যুনিজম রক্ষার সব অস্ত্র সব অর্থ সোভিয়েত ভান্ডারে থাকার পরও বৈরী জ্ঞান ও সংস্কৃতির সয়লাবে যেমন তা শেষ হয়ে গেছে, তেমনি, 'সেক্যুলার হিউম্যানিজম' এবং আগ্রাসী পুঁজি ও আধিপত্য রক্ষার 'গণতন্ত্র' তার ভান্ডারে সব অস্ত্র, সব অর্থ রেখেই শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রয়োজন শুধু ইসলামের মহান মানবতাবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধুনিকতম মানের প্রচন্ড এক সয়লাব।

লেখক-
আবুল আসাদ
সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম 
বই- একুশ শতকের এজেন্ডা

বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪

ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন || জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি

ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন || জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি


ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন

জাকাত বিলি-বণ্টনে রাসুল সাঃ এর নিয়মনীতি 

জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল-কুরআনে বারংবার নামাজ কায়েমের পরই জাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিনের নির্দেশেই জাকাত আদায়ের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সা) সাহাবীগণকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং এজন্যে একটা প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। কেন জাকাতের এই গুরুত্ব? ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বন্টন তথা সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবেই জাকাত গণ্য হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের জন্যে জাকাত একটি অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। জাকাতের সঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য সব ধরনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ইসলামের এই মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু সাধারণ করের ক্ষেত্রে কোন নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ নেই।

জাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে পার্থক্য:

জাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে অন্তত চারটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যথা:


প্রথমত: নির্দিষ্ট আয়ের বিপরীতে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে নির্ধারিত হারে কর প্রদান করতে হয়। এ জন্য করদাতা কোন প্রত্যক্ষ উপকার প্রত্যাশা করতে পারে না। সরকার করের মাধ্যমে অর্জিত এই অর্থ দরিদ্র ও অভাবী জনসাধারণের মধ্যে ব্যয়ের জন্যে বাধ্য থাকেন না। পক্ষান্তরে জাকাত হিসেবে আদায়কৃত অর্থ অবশ্যই আল-কুরআনে নির্দেশিত লোকদের মধ্যেই বন্টন করতে বা তাদের জন্যেই ব্যবহৃত হবে।


দ্বিতীয়ত: জাকাতের অর্থ রাষ্ট্রীয় সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু করের অর্থ যেকোন কাজে ব্যয়ের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা সরকারের রয়েছে।


তৃতীয়ত: জাকাত প্রদান শুধুমাত্র বিত্তশালী বা সাহেবে নিসাব মুসলিমদের জন্যেই বাধ্যতামূলক। কিন্তু কর বিশেষত পরোক্ষ কর, সর্বসাধারণের উপর আরোপিত হয়ে থাকে। অধিকন্তু প্রত্যক্ষ করেরও বিরাট অংশ জনসাধারণের উপর কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হয়।


চতুর্থত: জাকাতের হার পূর্বনির্ধারিত এবং স্থির। কিন্তু করের হার স্থির নয়। যে কোন সময়ে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী করের হার ও করযোগ্য বস্তু বা সামগ্রীর পরিবর্তন হয়ে থাকে।


সুতরাং, জাকাতকে কোনক্রমেই প্রচলিত অর্থে সাধারণ কর হিসেবে গণ্য করা যায় না বা তার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না।

যে সব বস্তুর উপর যাকাত ধার্য:

ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে যে সমস্ত সামগ্রীর উপর জাকাত ধার্য হয়েছে সেগুলি হলো-


১. ব্যাংকে/ হাতে সঞ্চিত/ জমাকৃত অর্থ;

২. সোনা, রূপা, এবং সোনা-রূপা দ্বারা তৈরি অলংকার;

৩. ব্যবসায়ের পণ্য সামগ্রী:

৪. জমির ফসল;

৫. খনিজ উৎপাদন; এবং

৬. সব ধরনের গবাদি পশু।


উপরোক্ত দ্রব্যসামগ্রীর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ যখন কোন মুসলমান অর্জন করে তখন তাকে জাকাত দিতে হয়। এই পরিমাণকে নিসাব বলে। নিসাবের সীমা বা পরিমাণ দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। একইভাবে জাকাতের হারও দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। জাকাতের সর্বনিম্ন হার শতকরা ২.৫%।

•জাকাতের খাত ও বন্টন নীতি:

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জাকাত কাদের প্রাপ্য অর্থাৎ কাদের মধ্যে জাকাতের অর্থ বন্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-


"দান-খয়রাত তো পাওনা হলো দরিদ্র ও অভাবীগণের, যে সকল কর্মচারীর উপর আদায়ের ভার আছে তাদের, যাদের মন (সত্যের প্রতি) সম্প্রতি অনুরাগী হয়েছে, গোলামদের মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর তরফ হতে ফরজ এবং আল্লাহ সব জানেন ও বুঝেন।" (সূরা আত-তাওবা: ৬০ আয়াত)


উপরের আয়াত হতে আট শ্রেণীর লোকদের মধ্যে জাকাতের অর্থ ব্যবহারের জন্যে সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়। সেগুলি হচ্ছে:


১. দরিদ্র জনসাধারণ;

২. অভাবী ব্যক্তি;

৩. যে সকল কর্মচারী জাকাত আদায়ে নিযুক্ত রয়েছে;

৪. নও-মুসলিম;

৫. ক্রীতদাস মুক্তি;

৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি;

৭. আল্লাহর পথে, এবং

৮. মুসাফির।


এই আটটি খাতের মধ্যে ছয়টিই দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্য দুটি খাতও (৩ ও ৭) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জাকাত আদায় ও ব্যবস্থাপনা একটি কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ কাজ। এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের এটাই সার্বক্ষণিক দায়িত্ব। সুতরাং, তাদের বেতন এই উৎস হতেই দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া যেসব ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে লিপ্ত তারাও অন্য কোনভাবে জীবিকা অর্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত। সুতরাং, উপরে বর্ণিত আটটি খাতেই যদি জাকাতের অর্থ ব্যয় হয় তাহলে দরিদ্রতা দূর হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য বহু অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার নিরসন হবে।

সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায়ে রাসুল সাঃ এর ভূমিকা:

রাসূলে করীম (সা) নিশ্চিতভাবেই জানতেন, ইসলামী রাষ্ট্রে মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাকাতের প্রতিষ্ঠা হলে বহুবিধ কল্যাণ সাধিত হবে। তাই তিনি জাকাত যথাযথ আদায় ও তার সুষ্ঠু বন্টনের জন্যে কঠোর তাগিদ দিয়ে গেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুষ্ঠুভাবে জাকাত আদায়ের জন্যে রাসূলে করীম (সা) নবম ও দশম হিজরিতে আরব ভূখন্ডের বারোটি এলাকায় বারোজন প্রখ্যাত সাহাবীকে দায়িত্ব প্রদান করেন।

অনুরূপভাবে পনেরোটি প্রধান গোত্র হতে জাকাত আদায়ের দায়িত্ব তিনি বারোজন খ্যাতনামা সাহাবীর উপর অর্পণ করেছিলেন।

রাসুল সাঃ এর বিলি বন্টন যারা করতেন:

জাকাত যথাযথ বিলি বন্টনের জন্যেও নবীজীর (সা) উদ্যোগেই বলিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল যা আজকের যেকোন উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে তুলনীয়। এ থেকেই বোঝা যায় জাকাত বায়তুলমালের কত বড় গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এই প্রতিষ্ঠানে নিচে বর্ণিত আট শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। এরা হচ্ছে-


১. সায়ী = গবাদি পশুর জাকাত সংগ্রাহক;

২. কাতিব = করণিক;

৩. কাসাম = বন্টনকারী;

৪. আশির = জাকাত প্রদানকারী ও জাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী;

৫. আরিফ = জাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী;

৬. হাসিব = হিসাব রক্ষক;

৭. হাফিজ = জাকাতের বস্তু ও অর্থ সংরক্ষক; এবং

৮. কায়াল = জাকাতের পরিমাণ নির্ণয় ও ওজনকারী।

জাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য:

জাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বহুবিধ। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান এবং মুখ্য হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে না দেওয়া। ইসলাম সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যকে শুধু নিন্দাই করে না, বরং তা দূরীভূত করার পদক্ষেপও অবলম্বন করতে বলে। তাই একটি সুখী, সুন্দর এবং উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাঁদের সম্পদের একটা অংশ ব্যয় করা উচিত। এর ফলে শুধু অসহায় ও দুস্থ মানবতার কল্যাণ হবে তাই নয়, আয়-বন্টনের বৈষম্যও হ্রাস পাবে। জাকাত প্রদানের ফলে সম্পদশালী মুসলিমের মন হতে ধন-সম্পদের লালসা দূরীভূত হবে। দরিদ্রদের অভাব মোচনের জন্যে নিজেদের দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে তারা সচেতন হবে। বিত্তবান মুসলমানদের আল্লাহ সৎপথে তাদের সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। বার্ষিক উদ্বৃত্ত অর্থ হতে নির্দিষ্ট হারে একটা অংশ দরিদ্র এবং দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের মধ্যে তারা বিতরণ করবেন। এর ফলে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবেন।


জাকাত মজুতদারি বন্ধ করারও এক প্রধান ও বলিষ্ঠ উপায়। মজুতকৃত সম্পদের উপরই জাকাত হিসেব করা হয়ে থাকে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ এবং মজুত সম্পদ যেকোন অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়ে তাকে। অবৈধভাবে অর্থ মজুত করার ফলে নানারকম সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা এর প্রকৃষ্ট নজির। অল্প কিছু লোকের হাতে বিপুল অবৈধ ও কালো টাকা জমেছিল। সরকারের এমন কোন কৌশল বা পদ্ধতি ছিল না যার দ্বারা এই অবৈধ অর্থের সঠিক পরিমাণ জানা সম্ভব ছিল। ফলে এসবের ব্যয় ও ব্যবহারের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়নি। পরিণামে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির ও সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যের।


কোন পদ্ধতিই সার্থকভাবে উপরোক্ত সমস্যার মুকাবিলা করতে সক্ষম নয়। একমাত্র ইসলামেই তার সমাধান রয়েছে। কারণ বিত্তবানদের জন্যে তাদের মজুতকৃত অর্থ বা সম্পদের একটা অংশ নিছক বিলিয়ে দেবার মতো কোন পার্থিব কারণ নেই। কিন্তু একজন মুসলমানের আল্লাহ ও আখিরাতের ভয় রয়েছে। উপরন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রবর্তিত আইনে সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতাও রয়েছে মজুত সম্পদকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ব্যয়, বিতরণ বা সরকারের কাছে সমর্পণে বাধ্য করতে। এর ফলে বিত্তবানদের সামনে দু'টি মাত্র পথ খোলা থাকবে-


১. শিল্প বা ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করা, অথবা

২. ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী তা ব্যয় করা।


জাকাতের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী সমাজ হতে দারিদ্র্য দূর করা। দারিদ্র্য মানবতার পয়লা নম্বরের দুশমন। ক্ষেত্রবিশেষে তা কুফরি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। যে কোন সমাজ ও দেশের এটা সবচেয়ে জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতির সৃষ্টি হয় দরিদ্রতার ফলে। পরিণামে দেখা দেয় সামাজিক সংঘাত। বহু সময়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটে। অধিকাংশ অপরাধই সচরাচর ঘটে দরিদ্রতার জন্যে। এ সমস্যাগুলির প্রতিবিধান করার জন্যে জাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার। যে আট শ্রেণীর লোকের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাকাত লাভের ফলে তাদের দিনগুলি আনন্দ ও নিরাপত্তার হতে পারে। জাকাত যথাযথভাবে আদায় ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হলে আজকের দিনেও এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।


একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের লোকদের মধ্যে যখন জাকাতের অর্থসামগ্রী বন্টন করে দেওয়া হয় তখন শুধু যে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তাই নয়, বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। দরিদ্র ও দুর্গত লোকদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। বেকারত্ব তাদের নিত্যসঙ্গী। জাকাত প্রাপ্তির ফলে তাদের হাতে অর্থাগম হলে বাজারে কার্যকর চাহিদার সৃষ্টি হয়। এরই ফলে দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নির্মাণ ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় অনুকূল পরিবেশ। ফলশ্রুতিতে প্রচলিত সামাজিক শ্রেণীসমূহের মধ্যে আয়গত পার্থক্যও হ্রাস পেতে থাকে।

মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামী দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়? -মাওলানা ইমাম হোসাইন


দ্বীন বিজয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা নিহত হয় ইসলামের পরিভাষাগত তাদেরকে শহীদ বলা হয়।

"শহীদ" এই পরিভাষাকে রাসুল (স) আরো ব্যাপকতা অর্থে ব্যবহার করেন। যেমন: জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু বলে, আগুনে পুড়ে নিহত হওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে,পানিতে ডুবে মারা যাওয়াকে শহীদি মৃত্যু বলে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃত্যুকেও শহীদি মৃত্যু বলে। শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা রেখে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করাকেও শহীদি মৃত্যু বলে।

কিন্তু সম্মুখ সমরে দ্বীনের জন্যে লড়াই করে শাহাদাত আর উল্লেখিত অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, আগুন এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের মর্যাদা এক নয়। বস্তুত এই দুই অবস্থার মৃত্যুকে তখনই শহীদি মৃত্যু বলা যাবে যদি মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হয়। অর্থাৎ শাহাদাতের সাথে ঈমান বা বিশ্বাসের ওতোপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।

পৃথিবীর সকল ন্যায় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তি কি শহীদ?

পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের অধিকার, সাম্য সমতা, মানবিক মর্যাদা, দেশ জাতির জন্য ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য মানুষ অসংখ্য আন্দোলনে মারা গিয়েছে। এদের সবাইকে শরীয়াহর মানদন্ডে শহীদ বলা যাবেনা। শহীদ বলতে হলে ঐ ন্যায্য আন্দোলনের সাথে ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, দেশ ও জাতির দ্বীন এবং ঈমানের অপরিহার্যতার সম্পর্ক লাগবে। এইজন্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের শহীদ বলা গেলেও হিন্দু সম্প্রাদায়ের নিহতদেরকে ইসলামী শরিয়াহর মানদণ্ডে কি শহীদ বলা যাবে? শহীদ হতে হলে ইসলামের বিশ্বাসকে ধারণ করতে হবে। কারণ শহীদ মর্যাদাটি ইসলামী পরিভাষা। মোটকথা কাউকে শহীদ বলতে হলে তার ইমানের অপরিহার্য সম্পৃক্ততা লাগবেই।

বাংলাদেশের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীদের শহীদ বলা হলেও কথিত মুলধারার জাতিয়তাবাদি, সেক্যুলার, সমাজতন্ত্রী কর্মীদেরকে কি শহীদ বলা যাবে?

[এই বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার পুর্বে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটগত এবং ব্যবহারগত শহীদ শব্দটির ২টি ধারা বিদ্যমান। যেমন: বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় মর্যাদাগত উপাধিতে দেশের আন্দোলনের যেকোন ব্যক্তিকে শহীদ বলা হয়। এক্ষেত্রে অনেক হিন্দু, নাস্তিক বামদেরকেও শহীদ উপাধি দিয়ে থাকে রাস্ট্র। যা ইসলামের মুলনীতির সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কিন্তু এই বাস্তবতাকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সবাইকে মানতে হয়।

দ্বিতীয়ত, দ্বীন আর ইসলামী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিকে ইসলামী দলসমূহ শহীদ বলে থাকে।ফিকহী উসুলের দিক থেকে ইসলামে এটাকেই শাহাদাত বলা হয়ে থাকে যা সকল যুগেরই প্রারম্ভনা আজ পর্যন্ত। ]

উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর হলো স্বৈরাচার জুলুমকে প্রতিহত করতে সকল দলমতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নিহত সবাইকে শহীদ বলতে হলে তাদেরকে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি থেকে বলতে হবে। উদাহরণগত জাতিয়তাবাদি, সমাজতন্ত্রবাদি, সেকুলারদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ন্যায্য হলেও পরক্ষণে তাদের বিশ্বাস যে তারা এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের মানব রচিত বিশ্বাসকে তারা প্রতিষ্ঠিত করবে। সুতরাং তাদের ন্যায্যত আন্দোলন সত্বেও বিশ্বাসের বিচ্যুতকারনে ইসলামী মুলনীতিতে শহীদ হবেনা। বিপরীতে ইসলামি দলগুলো স্বৈরাচার বিরোধী ন্যায্যত আন্দোলনে জুলুমের পতনের মধ্যদিয়ে ইসলামকেই প্রতিষ্ঠারই কর্মপ্রয়াস চালাবে। ফলশ্রুতি তাদের ন্যায্যত আন্দোলনে মাকাসাদ শরীয়াহ থাকার কারণে তাদের কোন কর্মী নিহত হলে শরীয়াহর মূলনীতিতে তাদেরকে শহীদ বলা যাবে।

মৌলিক জিজ্ঞাসা হলো স্বৈরাচার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামি দলের নিহত ব্যক্তিকে কি শহীদ বলা যায়?

সাধারণত ইসলামি দলগুলো সামগ্রিক গনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে না। মুলত গনতন্ত্র হলো আজকের বিশ্বের একটা নিয়মাতান্ত্রিক রাস্ট্রিয় পরিচালনা প্রক্রিয়া। যেখানে গনতন্ত্রের সকল মুলনীতির মাঝে কিছু আছে ইসলামের মূলনীতি সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে আর কিছু আছে যা ইসলামের চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এক্ষেত্রে ক্ষমতা পরিবর্তনে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামস্টিক দিক ইসলামের সমর্থন যোগ্য।তাই ইসলামি দলগুলো রাস্ট্রিয় পর্যায়ে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠায় জনমত গঠনে গনতন্ত্রের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাহন হিসেবে দেখে। যা একালের সকল ইসলামী রাস্ট্রচিন্তাবিদ্বের সর্বসম্মত মত।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জনমত তৈরীর একটি বাহন হিসেবে গনতন্ত্রের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিহত ইসলামী দলের কর্মীকে শহীদ বলা যাবে। বাহনগত দিক থেকে তা গনতান্ত্রিক আন্দোলন হলেও মাকাসাদে শরিয়াহ তথা উদ্দ্যেশ্যগত দিক থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

[এছাড়াও বাংলাদেশের এখনকার আন্দোলন মুলত নিয়মাতান্ত্রিক জুলুম তথা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, দেশ জাতি এবং সামগ্রিক ইসলামকে অক্ষুন্ন রাখার আন্দোলন। শুধুমাত্র একটা গনতন্ত্র শব্দ দিয়ে এই ন্যায্য আন্দোলনকে হালাল হারাম ফতোয়ার প্যাঁচে ফেলানো নিতান্তই চাটুলতা। ]

সুতরাং সকল আন্দোলনে যে কাউকে শহীদ বলতে হলে তার বিশ্বাস এবং মাকাসাদ তথা উদ্দ্যেশ্যে হতে হবে ইসলাম এবং শরীয়াহ। আর সকল ইসলামী দল তাদের সকল আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডের মাকাসাদ থাকে মূলত হুকুমতে শরিয়াহ এবং ইকামাতে দ্বীন।

[বি: দ্র: শাহাদাতের কবুলিয়াত আল্লাহর দিকেই নিসবত। কাউকে আমাদের শহীদ বলা না বলার মধ্যে শহীদি মর্যাদা নির্ভর করে না। মূলত এটি আখেরাতের অর্জন। দুনিয়াতে আপনি যাকে শহীদ বলতেছেন পরকালে সে হয়তো আল্লাহর নিকট শহীদ না। আবার আমরা যাকে শহীদ মনে করতেছিনা হয়তো সে আল্লাহর নিকট শহীদ। এইজন্য মুমিন সবসময় তার ভাইয়ের শাহাদাতের দোয়া করবে।]


লিখেছেন:
খতীব, দক্ষিণ মন্দিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ
ছাগলনাইয়া, ফেনী।

বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৩

যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান | প্রেমরোগের চিকিৎসা | আবদুল হামীদ ফাইযী


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ১

১- প্রেম আল্লাহর তরফ থেকে পাওয়া মানুষের জন্য এক বড় নেয়ামত। তা যথাস্থানে প্রয়োগ করা এক ইবাদত। আর তা অপপ্রয়োগ করা হল গোনাহর কাজ। অর্থাৎ অবৈধ প্রেম হল সচ্চরিত্রতা ও নৈতিকতার পরিপন্থী। বিবাহের পূর্বে হৃদয়ের আদান-প্রদান বা পছন্দ অথবা ভালোবাসার নামে যুবক-যুবতীর একত্রে ভ্রমণ-বিহার, নির্জনে খোশালাপ, অবাধ মিলামিশা ও দেখা-সাক্ষাৎ, গোপনে চিত্তবিনোদন প্রভৃতি আদর্শ ধর্ম ইসলামে বৈধ নয়। বর্তমান পরিবেশে কেবল সেই যুবকই অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে পারে, যার হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয়। আর আল্লাহর ভয় বুকে থাকলে শত বাধা ও বিপত্তির মাঝে চলার পথ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে -এই ভয়ে যে নিজের প্রবৃত্তি দমন করবে, তার ঠিকানা হবে বেহেশ্যে। বরং তার জন্য রয়েছে দুটি বেহেশ্ত।

পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে থাকলে আল্লাহ বান্দাকে এমন নোংরামি থেকে বাঁচিয়ে নেন। ঈমানে আল্লাহর প্রতি ইখলাস থাকলে তিনি বান্দাকে অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখেন। নবী ইউসুফ (আঃ) ও যুলাইখার ব্যাপারে তিনি বলেন, “সেই মহিলা তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত, যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন। প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য এইভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। নিশ্চয় সে ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের একজন।” (সূরা ইউসুফ ২৪ আয়াত)

সুতরাং মনের সন্দেহ ও কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হল ঈমান। ঈমান সুদৃঢ় রাখ, কারো অবৈধ ভালোবাসায় ফাসবে না এবং অবৈধ উপায়ে কেউ তোমার মন চুরি করতে পারবে না।

২- প্রেমরোগের সবচেয়ে বড় অব্যর্থ ও আসল ঔষধ হল ধৈর্য ও মনের দৃঢ়-সংকল্পতা এবং সুপুরুষের মত মনের স্থিরতা। ইচ্ছা পাকা থাকলে উপায়ের পথ বড় সহজ। ধৈর্য কঠিন হলেও তার পরিণাম বড় শুভ; যেমন গাছের ছাল তেঁতো হলেও তার ফল ভারি মিষ্টি।মনের খেয়াল-খুশীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৃঢ়-সংকল্প হও যে, তুমি ঐ শয়তানী কুমন্ত্রণায় সায় দেবে না। শয়তান হল তোমার প্রধান শত্রু এবং এই প্রণয়ের প্রধান দূত। আর মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয়---।” (সূরা নুর ২১ আয়াত)

অতএব ধৈর্যের সাথে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।

৩- নজর পড়ার সাথে সাথে মনের মানসপটে কোন রূপসীর ছবি অঙ্কিত হয়ে গেলে তার মন্দ দিকটা মনে করো। ভেবো, সে হয়তো আচমকা সুন্দরী, আসলে সুন্দরী নয়। নতুবা বোরকার ভিতরে হয়তো অসুন্দরী। নতুবা ওর হয়তো কোন অসুখ আছে। নতুবা ওর হয়তো বংশ ভালো নয়। নতুবা ওর হয়তো ঘর-বাড়ি ভালো নয়। নতুবা হয়তো ওর সাথে বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। নতুবা ও হয়তো তোমাকে পছন্দ করবে না। নতুবা ওর অতীত হয়তো কলঙ্কিত, ইত্যাদি। আঙ্গুর ফল নাগালের মধ্যে না পেলে টক মনে করলে মনে সবুর হয়।

তাছাড়া বেল পাকলে কাকের কি? দেখছ কি ভ্যাভ্যা? যার সরষে তার তেল! তাতে তোমার কাজও নেই, লাভও নেই।

৪- জীবনের প্রথম চাওয়াতে ভালো বলে যাকে তুমি ভালোবেসে মনের কাছে পেয়েছ, সেই তোমাকে ভালোবাসবে এবং সে ছাড়া তোমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না, বা আর কেউ তোমার কদর করবে না এমন ধারণা ভুল। ভালো কে? যার মনে লাগে যে তোমার ঐ লায়লার চেয়ে আরো ভালো লায়লা পেতে পার। সুতরাং বিবাহের মাধ্যমেও প্রেমময়ী ও গুণবতী সঙ্গিনী পাবে। তবে অবৈধভাবে ওর পেছনে কেন?

৫- প্রেম-পাগলা মজনু বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসছ, যে তোমাকে তার চোখের ইশারায় প্রেমের জালে আবদ্ধ করেছে, আজ যাকে তুমি তোমার জানের জান মনে করছ, কাল হয়তো সে তোমার অভাব দেখে, কোন অসুখ দেখে, কোন ব্যবহার দেখে অথবা তোমার চাইতে ভালো আর কোন নাগরের ইশারা দেখে, তোমাকে টা-টা’ দিতে পারে। যে তোমার ইশারায় তার নিজের মা-বাপ, বংশ, মান-সম্ভ্রম প্রভৃতি অমান্য ও পদদলিত করে তোমার কাছে এসে যেতে পারে, সে যে তোমার ও তোমার মা-বাপের মান রাখবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর এ কথাও জেনে রেখো যে, আজ তুমি মারা গেলে কাল সে আবার অন্যকে বিয়ে করে নতুন সংসারের নতুন বউ হবে। সুতরাং এমন প্রেমের প্রতিমার জন্য এত বলিদান কিসের?

প্রেমিক বন্ধু! পৃথিবীতে যত রকম আশ্চর্যময় জিনিস আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বেশী আশ্চর্যময় জিনিস হল মেয়ে মানুষের মন। সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। তাকে জয় করতে বড় পন্ডিত ও জ্ঞানী লোকেও হিমসিম খেয়ে যায়। সুতরাং তুমি কে? তুমিও হয়তো। একদিন বলতে বাধ্য হবে যে,

এ তুমি আজ সে - তুমি তো নহ, আজ হেরি তুমিও ছলনাময়ী,
তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী?
কিছু মেরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,
দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?
---প্রাণ নিয়ে এ কি নিদারুণ খেলা খেলে এরা হায়,
রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দলে অলক্তক পরে এরা পায়!

এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন প্রীতি।
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্থন,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীরু-বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি!
নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।
ইহাদের অতি লোভী মন,
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন!

বন্ধু আমার যদি তুমি ভাব যে, সব নারী তো আর এক রকম নয়। আমার লায়লা আমাকে ধোকা দেবে না। কিন্তু এ কথার নিশ্চয়তা কোথায় বন্ধু? তার কি কোন বন্ধনী বা বেষ্টনী আছে? আর একান্তই যদি তোমার ঐ ধারণা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অবৈধ প্রেম খেলে কেন, লুকোচুরি করে ফিসফিসিয়ে কেন, গোপন প্রেম-পত্র লিখে কেন? বরং বৈধ উপায়ে পয়গাম পাঠিয়ে তাকে তোমার প্রণয়-সুত্রে গেঁথে নাও। হালাল উপায়ে তুমি তাকে তোমার জীবনে নিয়ে এস এবং আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করো না।

৬- কোন তরুণীর রূপ দেখেই ধোকা খেয়ো না বন্ধু! প্রেমিকের চোখে প্রেমিকাই হল একমাত্র বিশ্বসুন্দরী। কিন্তু সে তো আবেগের খেয়াল, বাস্তব নয়। তাছাড়া দ্বীন ও চরিত্র না দেখে কেবল রূপে মজে গেলে সংসার যে সুখের হবে, তা ভেবো না। কারণ, চকচক করলেই সোনা হয় না। কাচ না কাঞ্চন তা যাচাই-বাছাই করা জ্ঞানী মানুষের কাজ। পরন্তু ফুলের সৌরভ ও রূপের গৌরব ক’দিনের জন্য? তাই অন্তরের সৌন্দর্য দেখা উচিত। আর সত্যিকারের সে সৌন্দর্য কপালের দুটি চোখ দিয়ে নয়, বরং মন ও জ্ঞানের গভীর দৃষ্টি দিয়েই দেখা সম্ভব। অতএব সেই মন যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পার তাহলে তুমি ‘ইন্না লিল্লাহ-- পড়। আর জেনে রেখো যে, এমন সৌন্দর্য ও দ্বীন ও গুণের অধিকারিণী রমণী কোন দিন লুকোচুরি করে তোমার সাথে প্রেম করতে আসবে না।

৭- স্ত্রী হল জীবনের চিরসঙ্গিনী। সংসারে যত রকমের সম্পদ ও ধন মানুষ পায়, তার মধ্যে পুণ্যময়ী স্ত্রীই হল সব চাইতে বড় ও শ্রেষ্ঠ ধন। সুখ ও দুঃখের সময় সাথের সাথী এই স্ত্রী। এই স্ত্রী ও সাথী নির্বাচন করতে হলে মনের আবেগ ও উপচীয়মান যৌবনের প্রেম ও কামনা দ্বারা নয়; বরং বিবেক ও মন দ্বারা দ্বীন ও চরিত্র দেখে ভেবে-চিন্তে নির্বাচন করতে হয়। তাহলেই পরিশেষে ঠকতে ও পস্তাতে হয় না।

৮- কারো চোখের অশ্রুর কথা বলছ? তবে জেনে রেখো যে, মেয়েদের চোখ থেকে দু’ রকমের অশ্রু ঝরে থাকে; একটি দুঃখের, অন্যটি ছলনার। আর এটাও তোমার মন ও প্রেমের আবেগ দিয়ে নয়, বরং প্রজ্ঞার বিবেক দিয়ে বুঝতে হবে।

প্রেম-বিহুল বন্ধু আমার পূর্বেই বলেছি, সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। নারীকে ছোট ও দুর্বল ভেবো না। সমুদ্র-উপকূলে দাঁড়িয়ে মহাসমুদ্রের যতটুকু দেখা যায়, ঠিক কোন নারীর ততটুকুই অংশ দেখা সম্ভব হয়। নারী দুয়ে, অজেয় নারীর মন। আর আমার মনে হয় যে, তুমি নিশ্চয়ই দিগবিজয়ী বীর নও।

৯- তুমি যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, সে ধনীর মেয়ে নয় তো? অর্থাৎ, কোন প্রকারে সে তোমার জীবনে এসে গেলে, তুমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বাসনা পূর্ণ করে চলতে পারবে তো? যদি তা না হয় তাহলে শোন, দরজা দিয়ে অভাব ঢুকলে জানালা দিয়ে ভালোবাসা লুকিয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং প্রেমের নামে নিজের জীবনে বঞ্চনা ও অভিশাপ ডেকে এনো না।

আবার কাউকে শুধু ভালো লাগলেই হয় না। তুমি তার বা তাদের পরিবেশ ও বাড়ির উপযুক্ত কি না, তাও ভেবে দেখ। নচেৎ বাওনের চাদ চাওয়ার মত ব্যাপার হলে শুধু শুধু মনে কষ্ট এনে লাভ কি? তাছাড়া তুমি যদি তোমার শিক্ষা, চরিত্র, ব্যবহার ও সাংসারিক যোগ্যতায় তাদেরকে মুগ্ধ করতে পার, তাহলে গরীব হলেও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। আর তুমিই হবে তাদের যোগ্য জামাই। পক্ষান্তরে লুকোচুরিতে চরিত্র নষ্ট করে থাকলে তুমি তাদের চোখে খারাপ হয়ে যাবে। শেষে আর জামাইও হতে পারবে না।

১০- প্রেম-ভিখারী বন্ধু আমার! প্রেম যদি করতেই চাও তাহলে ক্ষণস্থায়ী এ ঢলন্ত-যৌবনা ফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কেন? অসৎচরিত্রা অসতীদের সাথে কেন? হ্যা, সে অসতী বৈকি? যে তোমার সাথে অবৈধভাবে প্রেম করতে আসে, অবাধ মিলামিশ, দেখা-সাক্ষাৎ, চোখাচোখি, হাসাহাসি করে সে অসতী বৈকি?

সুতরাং প্রেম যদি করতেই হয় তাহলে চিরকুমারী অনন্ত-যৌবনা, অফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কর। কাঞ্চন-বদনা, সুনয়না, আয়তলোচনা, লজ্জা-বিনম্র, প্রবাল ও পদ্মরাগ-সদৃশ, উদ্ভিন্ন-যৌবনা ষােড়শীদের সাথে কর। যে তরুণীরা হবে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে পবিত্রা, যারা তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি নজর তুলেও দেখবে না। যে সুরভিতা রূপসীদের কেউ যদি পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে উঁকি মারে, তাহলে তার ঝলমলে রূপালোকে ও সৌরভে সারা বিশ্বজগৎ আলোকিত ও সুরভিত হয়ে উঠবে। যে সুরমার কেবলমাত্র মাথার ওড়না খানিকে পৃথিবী ও তার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও ক্রয় করা সম্ভব হবে না। (বুখারী ৬৫৬৮ নং)।

সুতরাং হালাল উপায়ে বিবাহ কর এবং তার সাথেই প্রেম কর। আর উভয়ে আল্লাহর আনুগত্য করার মাধ্যমে ঐ রূপসীদেরকে বিবাহ করার জন্য দেন-মোহর সংগ্রহ করতে লেগে যাও।

১১- অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে নির্জনতা ত্যাগ কর। কারণ, নির্জনতায় ঐ শ্রেণীর কুবাসনা মনে স্থান পায় বেশী। অতএব সকল অসৎ-চরিত্রের বন্ধু থেকে দুরে থেকে সৎ-বন্ধু গ্রহণ করে বিভিন্ন সৎ আলোচনায় প্রবৃত্ত হও। আল্লাহর যিকরে মনোযোগ দাও। বিভিন্ন ফলপ্রসু বইপুস্তক পাঠ কর। সম্ভব হলে সে জায়গা একেবারে বর্জন কর, যে জায়গায় পা রাখলে তার সহিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যে তোমার মন চুরি করে রেখেছে। টেলিফোন এলে তার কথার উত্তর দিও না। পত্র এলে জবাব দিও না। তোমার প্রণয়ের ব্যাপারে তাকে আশকারা দিও না। এমন ব্যবহার তাকে প্রদর্শন করো না, যার ফলে সে তোমার প্রতি আশা ও ভরসা করে ফেলতে পারে। বরং পারলে তাকে নসীহত করো এবং এমন অসৎ উপায় বর্জন করতে উপদেশ দিও। তাতে ফল না হলে পরিশেষে ধমক দিয়েও তাকে বিদায় দিও। আর বেকার বসে থেকো না। কোন না কোন কাজে, নিজের কাজ না থাকলে কোন সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা কর।

একা না ঘুমিয়ে কোন আত্মীয়, ভাই বা হিতাকাঙ্খী সৎ-বন্ধুর কাছে ঘুমাবার চেষ্টা কর। রাত্রে ঘুম না এলে যত কুরআন ও শয়নকালের দুআ মুখস্থ আছে শুয়ে শুয়ে সব পড়ে শেষ। করার চেষ্টা কর। 'সুবহানাল্লাহ’ ৩৩ বার, আহামদু লিল্লাহ’ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার” ৩৪ বার পাঠ কর। তার পরেও ঘুম না এলে, ঘুম না হলে তোমার কোন ক্ষতি হবে -এমন ভেবো না। অথবা রাত পার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে মনে আক্ষেপ করো না। এমন ভাবলে ও করলে আরো ঘুম আসতে চাইবে না। অতঃপর একান্ত ঘুম যদি নাই আসে তাহলে বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে নামায পড়তে শুরু কর। এর মাঝে ঘুমের আবেশ পেলে শুয়ে পড়। ঘুম না এলে বিছানায় উল্টাপাল্টা করলে অন্যান্য দুআ পড়ার পর এই দুআ পড়, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল ওয়াহিদুল কাহহার, রাব্দুস সামাওয়াতি অআরযি অমা বাইনাহুমাল আযীযুল গাফফার।

১২- গান-বাজনা শোনা থেকে দূরে থাক। কারণ, পুর্বেই জেনেছ যে, গানে যুব-মন প্রশান্তি পায় না; বরং মনের আগুনকে দ্বিগুণ করে জ্বালিয়ে তোলে। সুতরাং প্রেমময় মনের দুর্বলতা দূর করতে অধিকাধিক কবর যিয়ারত কর, জানাযায় শরীক হও, মরণকে স্মরণ কর। উলামাদের ওয়ায-মাহফিলে উপস্থিত হও, তাদের বক্তৃতার ক্যাসেট শোন।

১৩- অভিনয় দেখা পরিহার কর। কারণ, ফি-যাত্রা-নাটক-থিয়েটার ইত্যাদি তো প্রেমের আগুনে পেট্রোল ঢালে। আর এ সব এমন জিনিস যে, তাতে থাকে অতিরঞ্জিত প্রেম। অবাস্তব কাল্পনিক প্রেম-কাহিনী ও রোমান্টিক ঘটনাবলী। অতএব সে অভিনয় দেখে তুমি ভাবতে পার যে, তুমিও ঐ হিরোর মত প্রেমিক হতে পারবে, অথবা ঐ হিরোইনের মত তুমিও একজন প্রেমিকা পাবে, অথবা ঐ অভিনীত প্রেম তোমার বাস্তব-জীবনেও ঘটবে। অথচ সে ধারণা তোমার ভুল। পক্ষান্তরে ঐ সকল প্রেক্ষাগৃহ বা রঙ্গমঞ্চের ধারে-পাশে উপস্থিত হয়ে চিত্তবিনোদন করার মত গুণ আল্লাহর বান্দাদের নয়; বরং প্রবৃত্তির গোলামদের।

১৪- যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, তাকে কখনো একা নির্জনে কাছে পাওয়ার আশা ও চেষ্টা করো না। ব্যভিচার থেকে দুরে থাকলেও দর্শন ও আলাপনকে ক্ষতিকর নয় বলে অবজ্ঞা করো না। জেনে রেখো বন্ধু! যারা মহা অগ্নিকান্ডকে ভয় করে তাদের উচিত, আগুনের ছোট্ট অঙ্গার টুকরাকেও ভয় করা। উচিত নয় ছোট্ট এমন কিছুকে অবজ্ঞা করা, যা হল বড় কিছু ঘটে যাওয়ার ভূমিকা। ছোট্ট মশা নমরুদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ছোট ছোট পাখীদল। হস্তিবাহিনী সহ আবরাহাকে ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ছিদ্র একটি বিশাল পানি-জাহাজকে সমুদ্র-তলে ডুবিয়ে দিতে পারে। বিছার কামড়ে সাপ মারা যেতে পারে। সামান্য বিষে মানুষ মারা যায়। ক্ষুদ্র হুদহুদ পাখী বিলকীস রাণীর রাজত্ব ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ইদুর কত শত শহর ভাসিয়ে দিতে পারে বন্যা এনে। আর এ কথাও শুনে থাকবে যে, হাতির কানে নগণ্য পিঁপড়া প্রবেশ করলে অনেক সময় হাতি তার কারণেই মারা যায়।


প্রেমরোগের চিকিৎসা - ২

১৫- প্রেমিক বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। চোখ, কান, জিভ, হাত, পা এবং অনেক ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের ব্যভিচার সংঘটিত করে অবৈধ পিরীত। প্রিয়ার দিকে হেঁটে যাওয়া হল পায়ের ব্যভিচার। অতএব প্রেয়সীর প্রতি যে পথে ও পায়ে তুমি চলতে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত নও, সেই পথের উপর তোমার পায়ের নিশানা ও দাগকে কোন দিন ভয় করেছ কি?

ভেবেছ কি যে, তোমার ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেক নিশানা সযত্নে হিফাযত করে রাখা হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন, “আমিই মৃতকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি যা ওরা অগ্রে পাঠায় ও পশ্চাতে রেখে যায়। আমি প্রত্যেক জিনিসই স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি।” (সূরা ইয়াসীন ১২) প্রিয়তমার সাথে খোশালাপ হল জিভের ব্যভিচার। গোপন প্রিয়ার সাথে প্রেম-জীবনের সুমিষ্ট কথার রসালাপ তথা মিলনের স্বাদ বড় তৃপ্তিকর। কিন্তু বন্ধু! এমন সুখ তো ক্ষণিকের জন্য। তাছাড়া এমন সুখ ও স্বাদের কি মূল্য থাকতে পারে, যার পরবর্তীকালে অপেক্ষা করছে। দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ও দুঃখ। যে জিভ নিয়ে তুমি তোমার প্রণয়িণীর সাথে কথা বল, সে জিভের সকল কথা রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে, তা তুমি ভেবে দেখেছ কি? মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তাদের নিকটই আছে।” (সূরা ক্বাফ ৫০ আয়াত)

রসিক নাগর বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে তুমি প্রেমিকার সাথে মিলে যে পাপ করছ, সে পাপ কি ছোট ভেবেছ? ভেবে দেখ, হয়তো তোমাদের মাঝে এমন পাপও ঘটে যেতে পারে, যার। পার্থিব শাস্তি হল একশত কশাঘাত, নচেৎ প্রস্তরাঘাতে খুন। কিন্তু দুনিয়াতে এ শাস্তি থেকে কোন রকমে বেঁচে গেলেও আখেরাতে আছে জ্বলন্ত আগুনের চুল্লী। অতএব যে পুকুরের জল খাব না, সে পুকুরের পাড় দিয়ে যাব না’ -এটাই সুপুরুষের দৃঢ়সংকল্প হওয়া উচিত নয় কি? ভেবেছ কি যে, তুমি তোমার ভালোবাসার সাথে যে অবৈধ প্রেমকেলি, প্রমোদ-বিহার করছ, তা ভিডিও-রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। প্রীতির স্মৃতি রাখতে গিয়ে অনেক সময় যে ছবি তোমরা অবৈধ ও অশ্লীলভাবে তুলে রাখছ, তা একদিন ফাস হয়ে যাবে।

এ সব কিছুই মানুষের চোখে ফাকি দিয়ে করলেও কাল কিয়ামতে তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে। “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তা-ও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮ আয়াত) এবং তার যথার্থ প্রতিদানও পাবে। প্রেম-সুখী বন্ধু আমার! যে মাটির উপর তুমি ঐ অশ্লীলতা প্রেমের নামে করছ, সেই মাটি তোমার গোপন ভেদ গ্রামোফোন রেকর্ডের মত রেকর্ড করে রাখছে। কাল কিয়ামতে সে তা প্রকাশ করে দেবে। পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (ঐ ৪ আয়াত)

বন্ধু আমার। তুমি হয়তো তোমার ঐ প্রেমকেলিতে মানুষকে ভয় করছ, মা-বাপকে লজ্জা করছ। কিন্তু সদাজাগ্রত সেই সর্বস্রষ্টাকে লজ্জা ও ভয় করেছ কি? যে স্রষ্টা তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ তোমার দেহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার তৈরী দেহকে তারই অবাধ্যাচরণে ব্যবহার করছ। এ কথা তো তুমি বিশ্বাস কর যে, আমাদের মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত দেহ সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই দান। আমাদের ব্যবহারের জন্য তিনি আমাদের দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যথাস্থানে স্থাপন করে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। কিয়ামতে যখন আমরা আমাদের স্বকৃত পাপের কথা ভয়ে অস্বীকার করে বসব, তখন ঐ অঙ্গসমূহ কথা বলে আমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে সাক্ষি দেবে। (সূরা ইয়াসীন ৬৫ আয়াত)

সুতরাং এ দেহ আল্লাহর মালিকানায়, আমাদের মালিকানায় নয়। এ দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যদি তার অবাধ্যাচরণ ও বিরোধিতায় প্রয়োগ করি তাহলে তার চেয়ে বড় ধৃষ্টতা ও নির্লজ্জতা আর কি হতে পারে? আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করে তার ইবাদত করার জন্য পাঠালেন দুনিয়াতে এবং তার মহা প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন আখেরাতে। কিন্তু বান্দা যদি সেই প্রতিশ্রুতির কথা, আখেরাত ও মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়াই সর্বশেষ মনে করে, তবে নিশ্চয়ই তা লজ্জার কথা। এ জন্যই মহানবী %ি বলেন, “তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর।” সকলে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমরা তো -আলহামদু লিল্লাহ- আল্লাহকে লজ্জা করে থাকি। তিনি বললেন, “না ঐরূপ নয়।

আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, মাথা ও তার সংযুক্ত অন্যান্য অঙ্গ (জিভ, চোখ এবং কান)কে (অবৈধ প্রয়োগ হতে) হিফাযত করবে, পেট ও তার সংশ্লিষ্ট অঙ্গ (লিঙ্গ, হাত, পা ও হৃদয়)কে (তার অবাধ্যাচরণ ও হারাম হতে) হিফাযত করবে এবং মরণ ও তার পর হাড় মাটি হয়ে যাওয়ার কথা (সর্বদা) স্মরণে রাখবে। আর যে ব্যক্তি পরকাল (ও তার সুখময় জীবন) পাওয়ার ইচ্ছা রাখে, সে ইহকালের সৌন্দর্য পরিহার করবে। যে ব্যক্তি এ সব কিছু করে, সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করে।” (সহীহ তিরমিযী ২০০০ নং)

ভেবেছ কি বন্ধু! তোমার চোখ, কান, হাত, পা এবং শরীরের চামড়া পর্যন্ত কাল কিয়ামত কোর্টে আল্লাহর সামনে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে? কুরআন বলে, “পরিশেষে যখন ওরা দোযখের নিকট পৌছবে, তখন ওদের চোখ, কান ও ত্বক ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে---” (সূরা ফুসিলাত ২০ আয়াত) “যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিভ, তাদের হাত ও তাদের পা, তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে। সে দিন আল্লাহ তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে যে, আল্লাহই সত্য, স্পষ্ট ব্যক্তকারী।” (সূর নুর ২৪ আয়াত)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, “যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়কে ভয়ে নতজান হতে দেখবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার । আমলনামা (কর্মলিপি) দেখতে আহ্বান করা হবে। আর বলা হবে, তোমরা যা করতে আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হবে। আমার নিকট সংরক্ষিত এই আমলনামা, যা সত্যভাবে তোমাদের ব্যাপারে কথা বলবে। তোমরা যা করতে আমি তা লিপিবদ্ধ করতাম।” (সূরা জাসিয়াহ ২৭-২৯ আয়াত) “ওরা কি মনে করে যে, আমি ওদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফিরিশ্তাগণ তো ওদের নিকট থেকে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে।” (সূরা যুখরুফ ৮০ আয়াত)

গোপন-প্রেমিক বন্ধু আমার! ভালোবাসার নামে একজন উদাসীনা তরুণীকে গোপনে তার পিত্রালয় থেকে বের করে এনে কোন জায়গায় কোন মুন্সীকে ৫০/ ১০০ টাকা দিয়ে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ঘরের বউ করে তুলে আনলে, সে যে তোমার জন্য হালাল হবে না, তা তুমি জান কি? মহানবী ৪ বলেন, “যে নারী তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই নিজে নিজে বিবাহ করে, তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ৩১৩১নং)।

অর্থাৎ, ঐ বউ নিয়ে সংসার করলে চির জীবন ব্যভিচার করা হবে। যেমন ব্যভিচার হবে স্ত্রী থাকতে আপন শালীর প্রেম অনির্বাণ রাখতে গিয়ে তাকেও বউ করে ঘরে আনলে। যেমন দারুণ স্পর্শকাতর ঢাকঢাক গুড়গুড়’ পরিস্থিতিতে প্রিয়ার গর্ভে সন্তান ধারণ করা অবস্থায় গোপনে চটপট লজ্জা ঢাকার জন্য বিয়ে পড়িয়ে ফেলা হলেও তাকে নিয়ে সংসার বৈধ নয়। কারণ, বিবাহের পূর্বে বর-কনেকে ‘কোর্টশীপ বা হৃদয়ের আদান-প্রদানের কোন সুযোগ ইসলাম দেয়নি। আর সেক্সী কোন টেস্ট-পরীক্ষা তো নয়ই। অবশ্য উভয়ের জন্য একে অপরকে কেবল দেখে নেওয়ার অনুমতি আছে। তাছাড়া মহিলার গর্ভাবস্থায় বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ হয় না। সন্তান-প্রসবের পরই বিবাহ সম্ভব; যদিও সন্তান ঐ প্রেমিকেরই, যার সহিত প্রেমিকার বিবাহ হচ্ছে। বর্তমান পরিবেশে বিবাহ ও তালাককে এক প্রকার খেলা’ মনে করা হলেও, আসলে তা কিন্তু ঐ ধরনের কোন খেলা’ নয়।

সুতরাং নিজের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী প্রয়োগ করতে চাইলে আল্লাহর বিধানে তা বাতিল গণ্য হবে। জেনে রাখা ভালো যে, জোরপূর্বক কোন তরুণীকে বিবাহ করলে বিবাহ শুদ্ধ হয় না। যেমন কারো বিবাহিত স্ত্রীকে ভালোবেসে তুলে এনে তার সম্মতিক্রমে হলেও পূর্ব স্বামী তালাক না। দেওয়া পর্যন্ত এবং তার অভিভাবক সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত বিবাহ শুদ্ধ হয় না। তাকে নিয়ে সংসার করলে ব্যভিচার করা হয়। এ ছাড়া ভাইঝি, বোনঝি, সৎ মা, শাশুড়ী প্রভৃতি এগানা নারীর সাথে প্রেম ও ব্যভিচার করা সবচেয়ে বড় পশুত্ব! ১৬- কুলকুল-তান যৌবনের যুবক বন্ধু আমার! যদি কাউকে ভালো লেগেই যায়, তাহলে হালাল ও বিধেয় উপায়ে তাকে পাওয়ার চেষ্টা কর। আর ভেবো না যে, প্রেম করে বিয়ে বেশী সুখময়। বরং বিয়ে করলেই দায়িত্ববোধের সাথে প্রেমের চেতনা অধিক বাড়ে। এ পবিত্র প্রেমে কোন প্রকার ধোকা থাকে না, থাকে না কোন প্রকার অভিনয় ও কপটতা। যে নির্মল প্রেমে থাকে দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতা। আর এ জন্যই সমাজ-বিজ্ঞানী নবী # বলেন, “প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য বিবাহের মত অন্য কিছু (বিকল্প) নেই।” (ইবনে মাজাহ, হাকেম, সহীহুল জামে ৫২০০ নং)

অতএব প্রেম প্রকাশ ও বৃদ্ধি করা জন্য, প্রেমের ডালি খালি করার জন্য, প্রেম অনির্বাণ রাখার জন্য, প্রেম-রোগ উপশম করার জন্য, পবিত্র বিবাহ-বন্ধনের মত আর অন্য কোন বিকল্প গত্যন্তর নেই। তাই আল্লাহর কাছে দুআ করে গোপনে তোমার মানুষটিকে চেয়ে নাও এবং তাঁর নিকট হারামকারিতা থেকে শতবার পানাহ চাও। আর উপযুক্ত লোক লাগিয়ে বৈধ উপায়ে তাকে তোমার জীবন-সঙ্গিনী করে নাও। যে রতি হয়ে তোমার মনে এসেছিল, তাকে সতী হয়ে তোমার ঘরে আসতে দাও। যে প্রিয়া হয়ে প্রেমে ছিল, সে বধু হয়ে তোমার অধরে আসুক। যে তোমার দ্রাক্ষা-বুকে শিরীন-শারাব’ হয়ে এতদিন গোপনে লুকিয়ে ছিল, সে এবার প্রকাশ্যে তোমার পেয়ালায় এসে যাক।

কিন্তু একান্তই তোমার আশা যদি দুরাশা হয়ে থাকে, তুমি যেমন পাওয়ার যোগ্য, তার চাইতে বড় যদি চাওয়া হয়ে থাকে, অথবা অন্য কোন কারণে যদি তুমি তোমার গোপন প্রিয়াকে তোমার জীবন-তরীতে না-ই পেয়ে থাক, তাহলে দুঃখ করো না। নিশ্চয়ই তাতে তোমার কোন মঙ্গল আছেই আছে, তাই তুমি তাকে পাওনি৷ অতএব এ ক্ষেত্রে তাকে মনে চাপা দেওয়ার জন্য খোজ করে তার চেয়ে বা তারই মত একজন (দ্বীনদার) সুন্দরীকে তোমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়ে ফেল। এটাই তোমার দ্বীন-দুনিয়ার জন্য উত্তম। এতে তোমার পূর্ব নেশা কেটে যাবে, মন স্থির হয়ে সংসার সুখের হবে এবং ফাটা ও কাটা মনে

প্রলেপ পড়বে। আর বিবাহ যদি একান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে অবৈধ প্রণয় ও যৌনপ্রবৃত্তিকে দমন করতে আল্লাহর ওয়াস্তে রোযা পালন কর। ইনশাআল্লাহ, তোমার মনের সকল অঅসা’ দুর হয়ে যাবে, কারণ, রোযা হল তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতির কারখানা।

নারী-পাগলা বন্ধু আমার! পুরুষের পক্ষে নারীর ফিতনার মত বড় ফিতনা আর অন্য কিছু নেই। মহানবী (সা.) বলেন, “আমার গত হওয়ার পরে পুরুষের পক্ষে নারীর চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর কোন ফিতনা অন্য কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না।” (আহমাদ, বুখারী ৫০ ৯৬, মুসলিম ২৭৪০ নৎ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) নারী-ঘটিত ফিতনা অথবা নারীকে কেন্দ্র করে ঘটিত ফিতনার হার এ জগতে কম নয়। আর এই ফিতনায় পুরুষের ধন যায়, জ্ঞান হারায়, মান হারায়, দ্বীন হারায় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণও হারায়। তাই তো মহানবী (সা.) পুরুষকে সাবধান করে বলেন, “অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর জেনে রেখো যে, বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা যা ছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।” (আহমাদ, মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনে মাজাহ ৪০০০ নং)

শয়তানের যেমন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে, পুরুষের ব্যাপারে নারীরও বিভিন্ন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে উভয়ের চক্রান্তের কথা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিতাড়িত শয়তানের চক্রান্ত ও কৌশলের ব্যাপারে কুরআন বলেছে, “নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।” (সূরা নিসা ৭৬ আয়াত) পক্ষান্তরে নারীর কৌশল ও ছলনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় তোমাদের ছলনা ভীষণ!” (সূরা ইউসুফ ২৮ আয়াত)

সুতরাং জ্ঞানী বন্ধু! সাবধান থেকো। শয়তান ও নারীর চক্রান্ত-জালে ফেঁসে গিয়ে নিজের দ্বীনদুনিয়া বরবাদ করে দিও না। কেউ যদি তোমার কাছে অযাচিতভাবে প্রেম নিবেদন করতে চায়, তবে সর্বপ্রকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার ছলনায় সাড়া দিও না। আর মনে রেখো যে, “আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; (তারা হল,) ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ আযযা অজাল্লার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদ সমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।

সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।” (বুখারী ৬৬০নং, মুসলিম ১০৩১নং) ছলনাময়ী নারীর চক্রান্তে যাতে না পড়, তার জন্য বাংলা প্রবাদেও সতর্কবাণী এসেছে, তা মনে রেখো, কখনো খেয়ো নাকো তালে আর ঘোলে, কখনো ভুলো নাকো ঢেমনের বোলে। ঠিকই তো বালির বাঁধ, শঠের প্রীতি, এ দুয়ের একই রীতি। আর তাছাড়া জলের রেখা, খলের পিরীত’ থাকেও না বেশীক্ষণ। এ ধরনের চক্রান্তময় প্রেমে থাকে এক প্রকার সুড়সুড়ি, এক ধরনের স্বার্থ। যা শেষ হলে সব শেষ। সুতরাং মনে রেখো বন্ধু আমার! ‘জল-জঙ্গলনারী, এ তিনে বিশ্বাস নাই, বড়ই মন্দকারী।

নারী শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও এবং অনেকে নারীকে সামান্য জ্ঞান করলেও আসলে মনের দিক দিয়ে নারী বিশাল। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হল নারীর মন। সুবিস্তৃত মেঘমালা এবং ক্ষিপ্রপামী বাতাসের গতিবেগ হয়তো নির্ণয় করা সহজ; কিন্তু নারীর মনের গতিবেগ নির্ণয় করা মোটেই সহজ নয়। তা মাপা বা অনুমান করা আদৌ আসান নয়। আর এ জন্যই অনেকে সরল মনে নারীর ছলনার গরল পান করে ধোকা খায়।

বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা-ছায়া।

অতএব বন্ধু আমার! এমন নারীর ছলনা থেকে বাঁচার জন্য, এমন নারীর ফিতনা থেকে দূরে থাকার জন্য তুমি হযরত ইউসুফ নবী (আঃ) এর মত দুআ কর,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ

অর্থাৎ, হে পরোয়ারদেগার! ওরা আমাকে যে বিষয়ের দিকে আহ্বান করছে, তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। তুমি যদি আমাকে ওদের ছলনা হতে রক্ষা না কর, তবে আমি ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সূরা ইউসুফ ৩৩)।

মানুষের মন হল ফাকা ময়দানে পড়ে থাকা এক টুকরা হাল্কা পালকের মত। বাতাসের সামান্য দোলায় সে মন দুলতে থাকে, হিলতে থাকে, ছুটতে থাকে। মন হল পরিবর্তনশীল। সে মন থাকে আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে। তিনি মানুষের মন ঘুরিয়ে ও ফিরিয়ে থাকেন। অতএব এ বলেও দুআ করো তার কাছে,

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
অর্থাৎ, হে মনের গতি পরিবর্তনকারী! আমার মনকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখ।

-কপিরাইট: আবদুল হামীদ ফাইযী 

শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৩

সন্তানসমূহ হীরার খন্ড না হয়ে পাথরের নুড়ি হচ্ছে : মাওলানা ইমাম হোসাইন

কারণ: আমাদের সমাজের অধিকাংশ পিতামাতা গুলো সন্তানাদির ব্যাপারে অনেকটা ভরসা করে যে তারা আমাদের বৃদ্ধ বয়সের খুঁটি হবে, আর্থিক নিশ্চয়তার বাহন হবে। যারপরনাই তারা সন্তানাদিকে ছোট বয়স থেকে অনেকটা সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পিতামাতা সন্তানাদির সত্যিকার উন্নতি শিক্ষা, মেধা, নৈতিক উৎকর্ষতাকে যতটা না গুরুত্ব দিচ্ছে তার চেয়ে বেশী সন্তানের আর্থিক সচ্ছল হওয়াটাকে বেশী সাপোর্ট দিচ্ছে। 

যে সন্তানাদিগুলো শিক্ষাদীক্ষা বা নৈতিক উৎকর্ষতার দিকে যাচ্ছে কিন্তু আর্থিক সাপোর্ট আশানুরূপ করতে পারছে না তখন তার প্রতি পিতামাতা, পরিবার এবং এই সমাজের মানুষগুলো তুচ্ছ অবজ্ঞা দৃস্টিতে তাকাচ্ছে যে এই সন্তানগুলো তাদের বোঝা। ফলে একটা সময় এরা তাদের পড়াশোনা বা নৈতিক উৎকর্ষতা থেকে বের হয়ে  আর্থিক সচ্ছলতার জন্য তাদের সারাজীবনের আদর্শিক শিক্ষাটা কে ঘুষ, দুর্নীতির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। মুলত এই সমাজ পরিবার তাদেরকে অনেকটাই বাধ্য করছে। কারণ জাহল সমাজ তাকে মুল্যায়ন বা তুলনা করছে সমাজের ঐ শ্রেনীটার সাথে যে সমাজে নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, শিক্ষা দীক্ষার নিম্নস্তরে জাহল কিন্তু ধনবান। পরিবারে তুলনামুলক তাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে যে আর্থিক সাপোর্ট বেশী দেয় পরিবার মনে করছে আমার সেই সন্তান যেমন হোক তার আর্থিক সাপোর্টই মুল। তখন সমাজের শিক্ষিত সেই শ্রেনীটা হতাশার জায়গা থেকে বিচ্যুত পথ বেচে নেয়।

আজকে যদি আমাদের সকল পিতামাতাগুলো নিজেদের জীবনের সকল পর্যায়ে ভরসা করতো আল্লাহর উপর তাহলে তাদের বৃদ্ব বয়সে আর্থিক সাপোর্ট নিরাপত্তা আল্লাহ নিজ কুদরতে করতেন। কিন্তু যখনই তারা সন্তানাদির উপর ভরসা করে, তখনি তারা বৃদ্ধ বয়সে ঐ সন্তানাদি দ্বারা লাঞ্চিত হচ্ছে। মুলত পিতামাতা সমুহ যদি সন্তানাদি গুলোকে সত্যিকারার্থে আল্লাহর জন্য এবং উম্মাহর কল্যানের জন্য ওয়াকফ করতে পারতো দেখা যেত আল্লাহ তায়ালা এই সন্তানগুলো তাদের চক্ষু শীতলকারী এবং নিরাপত্তার বাহন হিসেবে তৈরী করে দিতো।

পিতামাতাসমুহের আরো একটি হিপোক্রেসি চিন্তা এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য করে তাহলো সন্তানাদির ভবিষ্যৎ জীবনের আর্থিক, বাস্তুসংস্থানিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ফলে তারা যেকোন পর্যায়ে হালাল-হারাম বিবাচনা না করে সন্তানদের জন্য টাকা আয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের হালাল অর্থের সাথে হারাম অর্থ মিশ্রিত হয়ে আয়কৃত সকল অর্থই হারামে রূপান্তরিত হয়। আর এই হারাম উপার্জিত টাকাগুলো যে সন্তানাদির ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবনের জন্য সঞ্চয় হয়েছিলো তখন ঐ সন্তানাদি গুলো এই টাকা দিয়ে মদ, জুয়া, ব্যাভিচারসহ নৈতিক পদস্থলের নিম্নে গিয়ে পৌছে যাচ্ছে। এবং সুন্দর জীবনের পরিবর্তে তাদের কুৎসিৎ জীবন হচ্ছে।

মুলত পিতামাতা যদি সন্তানাদির রিযিকের ব্যাপারে আল্লাহর তাকদীরের উপর বিশ্বাস করতো এবং নিজেরা অল্প তুস্টে হালাল ইনকামের মধ্যে থাকতো দিনশেষে দেখা যেতো তাদের সন্তানাদিগুলো হালাল উপার্জন ভক্ষনের মাধ্যমে এরা যুগের গাজ্জালি, তাইমিয়াহ, ইবনে কাসিরের মতো তৈরী হতো। হাজারবর্ষ পরেও মানুষ ঐ পিতামাতাগুলোকে পড়তো আর সম্মান করতো। কিন্তু আমাদের পিতামাতাগুলো নগদ লাভের আসায় তাদের হিরার খন্ড সন্তানগুলোকে পাথরের নুড়িতে পরিণত করছে।

আল্লাহ আমাদের সকল পিতামাতা সমূহকে তাদের সন্তানের ব্যাপারে সঠিক চিন্তা করার তাওফিক দান করুক, আমীন।


লিখেছেন:
খতীব, দক্ষিণ মন্দিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ
ছাগলনাইয়া, ফেনী।

শনিবার, ২৭ মে, ২০২৩

মাওলানা সুলতান আহমেদ ফারুকী রাহিমাহুল্লাহ্ (১৯৪৪-২০২৩) | একটি অমর জীবনী

“আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ রাহিমাহুল্লাহ্ (১৯৪৪-২০২৩) | একটি অমর জীবনী”   জন্ম ও বাল্যকাল: পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজান, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন জনাব আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ ফারুকী রাহিমাহুল্লাহ্ ১৯৪৪ সালের ২রা ডিসেম্বর ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলাধীন ৩নং মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের অন্তর্গত সমপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মো: মুসলিম মিয়া, মাতার নাম হাফেজা খাতুন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।   ছাত্রজীবন ও পড়াশোনা: ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দাখিল শেষ করেন ১৯৫৭ সালে ছাগলনাইয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে। বারৈয়ারহাট সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৬১ সালে আলিম ও ১৯৬৪ সালে ফাজিল শেষ করেন। সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করে ছাত্রজীবন শেষ করেন। বক্তারমুন্সী ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কাশেম হুজুর দাদার ক্লাসমেট ছিলেন। দাদার হাতের লিখা ছিলো খুবই চমৎকার।   কর্মজীবন ও অবসর: পাকিস্তান আমলে দাদা সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসিবে। শিক্ষকতা করাকালীন সময়ে লজিং ছিলেন মানিকছড়ির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেখানকার ছোট-বড় সকলেরই প্রিয়ভাজন ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসরে যান। দীর্ঘ প্রায় এত বছর পরেও দাদার ছাত্র-ছাত্রীরা দাদাকে কখনো ভুলেননি। বিশেষ করে দাদার দুই ছাত্রী শাহনাজ আন্টি ও রোকেয়া আন্টি দাদার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সুদুর খাগড়াছড়ি থেকে উনাদের পিতৃতুল্য প্রিয় স্যারকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন। অসুস্থ থাকাকালীনও এসে দাদাকে দেখে গিয়েছিলেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। কর্মজীবন শেষ করে অবসর সময়ে দাদা বাড়িতে নিয়মিত কৃষি কাজে সময় দিতেন ও গরু পালন করতেন। অলস সময় কাটাতেন না, অবসরে কুরআন তিলাওয়াত ও বিভিন্ন বইপুস্তকে মনোনিবেশ করতেন।   অনাড়ম্বর জীবন যাপন: ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। মার্জিত ব্যবহার এবং হাসিমাখা মুখখানি দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধা এবং ভক্তি চলে আসে। সদা-সর্বদা সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলার আশ্চর্য এক অনুপম গুণাবলির সমাহার ছিলেন। ছোট-বড় সবাইকে তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। লজ্জাশীলতা ও সহনশীলতা ছিলো অতুলনীয়! দাদা সবসময় ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পাগড়ী পরিধান করতেন, জামাকাপড় ছিলো সর্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। ৭৫+ বছর বয়সে এসেও দাদা নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন চশমা ছাড়া। সুস্থ সাবলীল ভাবেই চলাফেরা করতেন। এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি ছিলেন দাদা। এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই দাদাকে সমীহ করতেন। রাস্তায় সবসময় নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন। নিজের কাজ সবসময় নিজেই করার চেষ্টা করতেন। আমাদের বাড়িতে আজ পর্যন্ত টিভি চলা তো দূরের কথা, কোনদিন গানের আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। দাদা সবসময় জাঁকজমকপূর্ণতা পরিহার করে চলতেন। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে লাইটিং করা বা অতিরিক্ত সাজসজ্জা পছন্দ করতেন না। এসবের বিষয়ে তিনি বলতেন, 'এরকম কিছু করার চেষ্টা করলে আমি থাকবো না, বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যাবো।' দাদার সামনে আব্বু-কাকাদেরকে কখনো উঁচু আওয়াজে কথা বলতে দেখিনি।   পরহেজগারিতা: দাদা খুবই মুখলিস, পরহেজগার একজন মানুষ ছিলেন। কর্মজীবন থেকে অবসরে যাওয়ার পরই ২০০২ সালে হজ্জ করেন। দাদাকে জীবদ্দশায় কোনদিনও নামাজ ক্বাজা করতে দেখিনি। সবসময় চেষ্টা করতেন জামায়াতে তাকবীরে উলার সাথে নামাজ আদায় করার। আমাদের বাড়ি থেকে মসজিদ একটু দূরে হওয়ায় শেষ বয়সে এসে নিয়মিত মসজিদে যেতে দাদার কষ্ট হয়ে যেতো। সেজন্য বাড়ির দরজায় দাদার দান করা জমিতে ২০১৯ সালে দাদার নামে পাঞ্জেগানা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রেইন স্ট্রোক করে বিছানায় শয্যাশায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কখনো সজ্ঞানে নামাজ ক্বাজা করেননি। শেষ সময়ে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায়ও তিনি অসংখ্যবার নামাজ পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন। হাসপাতালে থাকাবস্থায় প্রায়ই বলতেন, 'আরমান আমাকে অজু করিয়ে দাও, নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে।' অথচ তখন তিনি নিজের শক্তিতে এপাশ-ওপাশ হওয়ার মতো অবস্থায়ও ছিলেন না।   সুস্থ থাকাবস্থায় তিনি প্রতি রমজানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করতেন। জুম'আর দিন নামাজের আজান দেওয়ার সাথে সাথে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। হাঁটতে-চলতে, কাজে-কর্মে সবসময়ই মুখে জিকির লেগে থাকতো। মৃত্যুশয্যায় তিনি প্রায়ই সশব্দে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়তেন, এবং বলতেন 'সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার হচ্ছে গুনাহ মাফের সর্দার, তোমরা এটা সবসময় পড়বে।' দাদার খাওয়া-দাওয়া ছিল পরিমিত, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেতেন না। তিনি বলতেন, ‘বেশী খেলে এগুলোর হিসাব ‍দিবো কিভবে?’ দাদা কখনো দাঁড়িয়ে পানি পান করতেন না। যে কোন খাবার শুরুর পূর্বে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে তারপর খেতেন। খাওয়ার শেষেও সশব্দে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়তেন। দাদা কখনো ছবি তুলতেন না। হায়াতের শেষ দিকে এসে সামান্য কিছু ছবি ছাড়া দাদার আর খুব বেশী ছবি নেই।   পারিবারিক জীবন: পারিবারিক জীবনে দাদা ছিলেন সফল একজন অভিভাবক, তিনি ছিলেন পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের পিতা। ছেলে ও মেয়ের ঘরের প্রায় ২৬ জন নাতি-নাতনী রেখে গেছেন। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে তিনি ইসলাম শিক্ষায় শিক্ষিত ও ইসলামী জীবনধারায় অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেছেন। দাদা ইসলাম পালনের বিষয়ে কখনো ছাড় দিতেন না। সবাইকে ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করাতেন এবং সর্বদা দ্বীনি আন্দোলনে শামিল থাকতে উৎসাহিত করতেন। দাদা নিজেও ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী। যখনই বাড়িতে যেতাম, তিনি আগে সাংগঠনিক কাজকর্ম কেমন চলছে খোঁজখবর নিতেন। জানাযায় আগত মুসল্লী বৃন্দ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, দাদার প্রত্যেক সন্তানকে তিনি মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বড় নাতি হিসেবে দাদাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও দাদার সান্নিধ্যে থেকে অনেক কিছু শিখার সুযোগ হয়েছে, যা জীবন চলার পথে পাথেয় হিসেবে আমরণ কাজে লাগবে।   সমাজসেবা: দাদা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সর্বদা মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। কাউকে কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে দেখিনি, যতটুকু পারতেন সামর্থ্যের আলোকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আত্মীয়-প্রতিবেশী সবার খোঁজখবর রাখতেন এবং সবার জন্য দু’আ করতেন। কারো মৃত্যুর সংবাদ পেলে জানাযায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন।   অসুস্থতা: দাদা ছিলেন অনেক আগে থেকেই ডায়াবেটিসের রোগী। দীর্ঘদিন যাবৎ কাশি সমস্যায় ভুগছিলেন, অনেক চিকিৎসার পরও তা সমাধান করা যায়নি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দাদার ডান চোখের ছানি অপারেশন করে লেন্স বসানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে দাদার চিকিৎসার কাজে দাদার সাথেই অনেক জায়গায় ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে, দাদাকে কখনোই অধৈর্য্য বা পেরেশান হতে দেখিনি। ব্রেইন ষ্ট্রোক: ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ইং দুপুর ১২টায় হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন পাই, দাদা বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় সাথে সাথে ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। ডাক্তার জানালেন ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। ফেনীতে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিকেলে সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা নিয়ে যাওয়ার। রাতে দাদাকে নিয়ে ভর্তি করালাম ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। পাঁচদিনের চিকিৎসা শেষে অবস্থা উন্নতি হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে বাড়িতে শিফট করি।   ১৭ মার্চ পুনরায় অবস্থার অবনতি ঘটে। দ্রুত ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসলে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখে ডাক্তার তাৎক্ষনিক সিসিইউতে ভর্তি করে। তিনদিন সিসিইউতে থাকার পর অবস্থা একটু উন্নতি হলে কেবিনে শিফট করা হয়। ২২ তারিখ বিকেলে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। সেদিন নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আলাউদ্দিন স্যারের সিরিয়াল দিয়েও অল্প সময়ের জন্য না দেখাতে পারার আফসোফটা থেকে যাবে!  "ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালের সিসিইউতে শয্যাশায়ী অবস্থায় দাদা"   রমজানের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় ফেনীতে নিউরোমেডিসিন ডাক্তার দেখানো হয়। সেটাই ছিলো শেষ ডাক্তার দেখানো। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।   দাদার অসুস্থতার খবর শুনে দেশ-বিদেশ থেকে দাদার অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী/শুভানুধ্যায়ীরা নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে থাকা অবস্থায় দাদাকে দেখতে আসেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি, দাগনভূঞা-সোনাগাজী উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব ডাঃ ফখরুদ্দিন মানিক ভাই।   দাদার সাথে আমার শেষ কথোপকথন: আমি: দাদা! সকালে প্রোগ্রাম আছে, আমি ফেনী চলে যাচ্ছি। দাদা: আল্লাহর হাওলা, ফি আমানিল্লাহ। সাবধানে থাকিও, আমার জন্য দোয়া করিও। আমি: ঠিক আছে দাদা! আমার জন্যও দোয়া করবেন, ফি আমানিল্লাহ।   শেষ বিদায়: দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস শয্যাশায়ী থাকার পর ০৮ই এপ্রিল ২০২৩ইং রোজ সোমবার রাত ২টা ৪৫ মিনিটে দাদা দুনিয়ার সফর শেষ করে মহান রবের দরবারে পাড়ি জমান। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে দাদার বয়স ছিলো প্রায় ৮০ বছর।   "দাদার জানাযায় উপস্থিতির একাংশ" জানাযায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি ও চোখের পানিই প্রমাণ করে, দল-মত নির্বিশেষে দাদা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও ফেনী জেলা সেক্রেটারী, ফেনী আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসার সম্মানিত ফকীহ জনাব মুফতী আবদুল হান্নান হুজুর।   দুনিয়ার জীবনের এই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি রেখে গেছেন অসংখ্য শুভাকাংক্ষী, শুভানুধ্যায়ী ও গভীর রজনীতে সিজদাবনত চিত্তে উনার নাম ধরে দু’আ করার মতো একঝাঁক পরিবার-পরিজন, নাতি-নাতনী ও অগণিত আত্মীয়-স্বজন।   আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজানের জীবনের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন, উনার রেখে যাওয়া আদর্শকে অনুসরন করে আমাদেরকে বাকি জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দিন, দুনিয়ার জীবনের সকল ভালো কাজ ও নেক আমলকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে পরকালীন জীবনে নাজাতের উছিলা হিসেবে কবুল করে নিন, আমীন।   দু'আ কামনায়- ইমাম হোসেন আরমান, দাদার বড় নাতি(ছেলের ঘরের)।

“আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ রাহিমাহুল্লাহ্ (১৯৪৪-২০২৩) | একটি অমর জীবনী”

•জন্ম ও বাল্যকাল:
পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজান, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন জনাব আলহাজ্ব মাওলানা সুলতান আহমেদ ফারুকী রাহিমাহুল্লাহ্ ১৯৪৪ সালের ২রা ডিসেম্বর ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলাধীন ৩নং মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের অন্তর্গত সমপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মো: মুসলিম মিয়া, মাতার নাম হাফেজা খাতুন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

•ছাত্রজীবন ও পড়াশোনা:
ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দাখিল শেষ করেন ১৯৫৭ সালে ছাগলনাইয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে। বারৈয়ারহাট সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৬১ সালে আলিম ও ১৯৬৪ সালে ফাজিল শেষ করেন। সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে ফেনী আলিয়া কামিল মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করে ছাত্রজীবন শেষ করেন। বক্তারমুন্সী ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কাশেম হুজুর দাদার ক্লাসমেট ছিলেন। দাদার হাতের লিখা ছিলো খুবই চমৎকার। 

•কর্মজীবন ও অবসর:

পাকিস্তান আমলে দাদা সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসিবে। শিক্ষকতা করাকালীন সময়ে লজিং ছিলেন মানিকছড়ির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেখানকার ছোট-বড় সকলেরই প্রিয়ভাজন ছিলেন।
২০০১ সালে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসরে যান। দীর্ঘ প্রায় এত বছর পরেও দাদার ছাত্র-ছাত্রীরা দাদাকে কখনো ভুলেননি। বিশেষ করে দাদার দুই ছাত্রী শাহনাজ আন্টি ও রোকেয়া আন্টি দাদার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সুদুর খাগড়াছড়ি থেকে উনাদের পিতৃতুল্য প্রিয় স্যারকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে আসেন। অসুস্থ থাকাকালীনও এসে দাদাকে দেখে গিয়েছিলেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন।
কর্মজীবন শেষ করে অবসর সময়ে দাদা বাড়িতে নিয়মিত কৃষি কাজে সময় দিতেন ও গরু পালন করতেন। অলস সময় কাটাতেন না, অবসরে কুরআন তিলাওয়াত ও বিভিন্ন বইপুস্তকে মনোনিবেশ করতেন। 

•অনাড়ম্বর জীবন যাপন:
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। মার্জিত ব্যবহার এবং হাসিমাখা মুখখানি দেখলে মন থেকে শ্রদ্ধা এবং ভক্তি চলে আসে। সদা-সর্বদা সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলার আশ্চর্য এক অনুপম গুণাবলির সমাহার ছিলেন। ছোট-বড় সবাইকে তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। লজ্জাশীলতা ও সহনশীলতা ছিলো অতুলনীয়! দাদা সবসময় ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পাগড়ী পরিধান করতেন, জামাকাপড় ছিলো সর্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন।
৭৫+ বছর বয়সে এসেও দাদা নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন চশমা ছাড়া। সুস্থ সাবলীল ভাবেই চলাফেরা করতেন। এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি ছিলেন দাদা। এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই দাদাকে সমীহ করতেন।
রাস্তায় সবসময় নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন। নিজের কাজ সবসময় নিজেই করার চেষ্টা করতেন।
আমাদের বাড়িতে আজ পর্যন্ত টিভি চলা তো দূরের কথা, কোনদিন গানের আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। দাদা সবসময় জাঁকজমকপূর্ণতা পরিহার করে চলতেন। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে লাইটিং করা বা অতিরিক্ত সাজসজ্জা পছন্দ করতেন না। এসবের বিষয়ে তিনি বলতেন, 'এরকম কিছু করার চেষ্টা করলে আমি থাকবো না, বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যাবো।'
দাদার সামনে আব্বু-কাকাদেরকে কখনো উঁচু আওয়াজে কথা বলতে দেখিনি।

•পরহেজগারিতা
দাদা খুবই মুখলিস, পরহেজগার একজন মানুষ ছিলেন। কর্মজীবন থেকে অবসরে যাওয়ার পরই ২০০২ সালে হজ্জ করেন। দাদাকে জীবদ্দশায় কোনদিনও নামাজ ক্বাজা করতে দেখিনি। সবসময় চেষ্টা করতেন জামায়াতে তাকবীরে উলার সাথে নামাজ আদায় করার।
আমাদের বাড়ি থেকে মসজিদ একটু দূরে হওয়ায় শেষ বয়সে এসে নিয়মিত মসজিদে যেতে দাদার কষ্ট হয়ে যেতো। সেজন্য বাড়ির দরজায় দাদার দান করা জমিতে ২০১৯ সালে দাদার নামে পাঞ্জেগানা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ব্রেইন স্ট্রোক করে বিছানায় শয্যাশায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কখনো সজ্ঞানে নামাজ ক্বাজা করেননি। শেষ সময়ে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায়ও তিনি অসংখ্যবার নামাজ পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন। হাসপাতালে থাকাবস্থায় প্রায়ই বলতেন, 'আরমান আমাকে অজু করিয়ে দাও, নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে।' অথচ তখন তিনি নিজের শক্তিতে এপাশ-ওপাশ হওয়ার মতো অবস্থায়ও ছিলেন না।

সুস্থ থাকাবস্থায় তিনি প্রতি রমজানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করতেন। জুম'আর দিন নামাজের আজান দেওয়ার সাথে সাথে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। হাঁটতে-চলতে, কাজে-কর্মে সবসময়ই মুখে জিকির লেগে থাকতো। মৃত্যুশয্যায় তিনি প্রায়ই সশব্দে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়তেন, এবং বলতেন 'সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার হচ্ছে গুনাহ মাফের সর্দার, তোমরা এটা সবসময় পড়বে।'
দাদার খাওয়া-দাওয়া ছিল পরিমিত, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেতেন না। তিনি বলতেন, ‘বেশী খেলে এগুলোর হিসাব ‍দিবো কিভবে?’ দাদা কখনো দাঁড়িয়ে পানি পান করতেন না। যে কোন খাবার শুরুর পূর্বে সশব্দে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে তারপর খেতেন। খাওয়ার শেষেও সশব্দে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়তেন।
দাদা কখনো ছবি তুলতেন না। হায়াতের শেষ দিকে এসে সামান্য কিছু ছবি ছাড়া দাদার আর খুব বেশী ছবি নেই।

•পারিবারিক জীবন:
পারিবারিক জীবনে দাদা ছিলেন সফল একজন অভিভাবক, তিনি ছিলেন পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের পিতা। ছেলে ও মেয়ের ঘরের প্রায় ২৬ জন নাতি-নাতনী রেখে গেছেন।
পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে তিনি ইসলাম শিক্ষায় শিক্ষিত ও ইসলামী জীবনধারায় অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেছেন। দাদা ইসলাম পালনের বিষয়ে কখনো ছাড় দিতেন না। সবাইকে ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবন করাতেন এবং সর্বদা দ্বীনি আন্দোলনে শামিল থাকতে উৎসাহিত করতেন।
দাদা নিজেও ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী। যখনই বাড়িতে যেতাম, তিনি আগে সাংগঠনিক কাজকর্ম কেমন চলছে খোঁজখবর নিতেন।
জানাযায় আগত মুসল্লী বৃন্দ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, দাদার প্রত্যেক সন্তানকে তিনি মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
বড় নাতি হিসেবে দাদাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও দাদার সান্নিধ্যে থেকে অনেক কিছু শিখার সুযোগ হয়েছে, যা জীবন চলার পথে পাথেয় হিসেবে আমরণ কাজে লাগবে।

•সমাজসেবা:
দাদা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সর্বদা মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। কাউকে কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে দেখিনি, যতটুকু পারতেন সামর্থ্যের আলোকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আত্মীয়-প্রতিবেশী সবার খোঁজখবর রাখতেন এবং সবার জন্য দু’আ করতেন। কারো মৃত্যুর সংবাদ পেলে জানাযায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন।

•অসুস্থতা:
দাদা ছিলেন অনেক আগে থেকেই ডায়াবেটিসের রোগী। দীর্ঘদিন যাবৎ কাশি সমস্যায় ভুগছিলেন, অনেক চিকিৎসার পরও তা সমাধান করা যায়নি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দাদার ডান চোখের ছানি অপারেশন করে লেন্স বসানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে দাদার চিকিৎসার কাজে দাদার সাথেই অনেক জায়গায় ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে, দাদাকে কখনোই অধৈর্য্য বা পেরেশান হতে দেখিনি।
ব্রেইন ষ্ট্রোক: ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ইং দুপুর ১২টায় হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন পাই, দাদা বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় সাথে সাথে ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। ডাক্তার জানালেন ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। ফেনীতে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিকেলে সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা নিয়ে যাওয়ার। রাতে দাদাকে নিয়ে ভর্তি করালাম ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। পাঁচদিনের চিকিৎসা শেষে অবস্থা উন্নতি হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে বাড়িতে শিফট করি।

১৭ মার্চ পুনরায় অবস্থার অবনতি ঘটে। দ্রুত ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিয়ে আসলে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখে ডাক্তার তাৎক্ষনিক সিসিইউতে ভর্তি করে। তিনদিন সিসিইউতে থাকার পর অবস্থা একটু উন্নতি হলে কেবিনে শিফট করা হয়। ২২ তারিখ বিকেলে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। সেদিন নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আলাউদ্দিন স্যারের সিরিয়াল দিয়েও অল্প সময়ের জন্য না দেখাতে পারার আফসোফটা থেকে যাবে!


"ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালের সিসিইউতে শয্যাশায়ী অবস্থায় দাদা"

রমজানের মাঝামাঝি সময়ে পুনরায় ফেনীতে নিউরোমেডিসিন ডাক্তার দেখানো হয়। সেটাই ছিলো শেষ ডাক্তার দেখানো। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।

দাদার অসুস্থতার খবর শুনে দেশ-বিদেশ থেকে দাদার অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী/শুভানুধ্যায়ীরা নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। ঢাকা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে থাকা অবস্থায় দাদাকে দেখতে আসেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব ডাঃ ফখরুদ্দিন মানিক ভাই।

•দাদার সাথে আমার শেষ কথোপকথন:
আমি: দাদা! সকালে প্রোগ্রাম আছে, আমি ফেনী চলে যাচ্ছি।
দাদা: আল্লাহর হাওলা, ফি আমানিল্লাহ। সাবধানে থাকিও, আমার জন্য দোয়া করিও।
আমি: ঠিক আছে দাদা! আমার জন্যও দোয়া করবেন, ফি আমানিল্লাহ।

•শেষ বিদায়:
দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাস শয্যাশায়ী থাকার পর ০৮ই এপ্রিল ২০২৩ইং রোজ সোমবার রাত ২টা ৪৫ মিনিটে দাদা দুনিয়ার সফর শেষ করে মহান রবের দরবারে পাড়ি জমান। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন।
মৃত্যুকালে দাদার বয়স ছিলো প্রায় ৮০ বছর।

"দাদার জানাযায় উপস্থিতির একাংশ"

জানাযায় হাজারো মানুষের উপস্থিতি ও চোখের পানিই প্রমাণ করে, দল-মত নির্বিশেষে দাদা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ও ফেনী জেলা সেক্রেটারী, ফেনী আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসার সম্মানিত ফকীহ জনাব মুফতী আবদুল হান্নান হুজুর।

দুনিয়ার জীবনের এই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি রেখে গেছেন অসংখ্য শুভাকাংক্ষী, শুভানুধ্যায়ী ও গভীর রজনীতে সিজদাবনত চিত্তে উনার নাম ধরে দু’আ করার মতো একঝাঁক পরিবার-পরিজন, নাতি-নাতনী ও অগণিত আত্মীয়-স্বজন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরম শ্রদ্ধেয় দাদাজানের জীবনের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন, উনার রেখে যাওয়া আদর্শকে অনুসরন করে আমাদেরকে বাকি জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দিন, দুনিয়ার জীবনের সকল ভালো কাজ ও নেক আমলকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে পরকালীন জীবনে নাজাতের উছিলা হিসেবে কবুল করে নিন, আমীন।

দু'আ কামনায়-
ইমাম হোসেন আরমান,
দাদার বড় নাতি(ছেলের ঘরের)